স্বরধ্বনি | স্বরধ্বনি কাকে বলে
স্বরধ্বনির সংজ্ঞা ও বিভিন্ন প্রকার স্বরধ্বনি
স্বরধ্বনি কাকে বলে?
স্বরধ্বনি কাকে বলে, এ বিষয়ে একটি পুরাতন সংজ্ঞা প্রচলিত আছে---- "যে ধ্বনিকে অন্য ধ্বনির সাহায্য ছাড়াই উচ্চারণ করা যায়, তাকে স্বরধ্বনি বলে।" স্বরধ্বনির এই সংজ্ঞাটি ভুল নয়। তবে এটি ধ্বনিতাত্ত্বিক বা ভাষাতাত্ত্বিক সংজ্ঞা নয়।
ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বরধ্বনির সংজ্ঞা:
যে ধ্বনিকে উচ্চারণ করার জন্য শ্বাসবায়ুকে বাগ্যন্ত্রের কোথাও বাধা দিতে হয় না, তাকে স্বরধ্বনি বলে।
স্বরধ্বনির একটি বৈশিষ্ট্য হলো: একে অন্য ধ্বনির সাহায্য ছাড়াই উচ্চারণ করা যায়।
স্বর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পুরো লেখাটি পড়ুন।
এখন আমাদের জেনে নেওয়া প্রয়োজন যে, ধ্বনি সৃষ্টি হয় কী ভাবে। ধ্বনি সৃষ্টির জন্য প্রথমে আমাদের ফুসফুস থেকে আমরা নিঃশ্বাসবায়ু নির্গত করি। এই বায়ুর গতিপথে প্রথমে পড়ে স্বরতন্ত্রী নামে দুটি পাতলা পর্দা। এই পর্দাগুলি থাকে আমাদের স্বরকক্ষের মধ্যে। এগুলি প্রয়োজন মত কাছাকাছি আসতে পারে অথবা পরস্পরের থেকে দূরে যেতে পারে। এদের মধ্য দিয়ে যখন বায়ু প্রবাহিত হয়, তখন এগুলি কাঁপতে থাকে। তবে এই কম্পন থেকে সব সময় ধ্বনি উৎপন্ন নাও হতে পারে। কেন হবে না, সে প্রসঙ্গে এখন যাচ্ছি না। আপাতত এটুকু আমরা বুঝলাম যে, স্বরতন্ত্রীর মধ্য দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হলে সেখানে কম্পন হবে এবং কম্পনের ফলে ধ্বনি উৎপন্ন হতে পারে বা ঠিকমত কম্পন না হলে শ্রবণযোগ্য ধ্বনি উৎপন্ন নাও হতে পারে। এ ছাড়া নিঃশ্বাসবায়ুকে বাগযন্ত্রের অন্যত্র অর্থাৎ কণ্ঠনালী বা মুখগহ্বরের কোনো অংশে বাধা দিলে বায়ু সেই বাধা অতিক্রম করে প্রবাহিত হয়। এইভাবে বাগ্যন্ত্রের বাধা অতিক্রম করে শ্বাসবায়ু প্রবাহিত হবার সময়ও ধ্বনি সৃষ্টি হতে পারে।
এইবার আমরা আসি স্বরধ্বনির জন্ম প্রসঙ্গে। উপরের দুটি পদ্ধতির মধ্যে প্রথম পদ্ধতিটিতে স্বরধ্বনির জন্ম হয়। অর্থাৎ, শ্বাসবায়ু স্বরতন্ত্রীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হবার সময় পর্দা দুটি এমনভাবে কাঁপে যে শ্রবণযোগ্য ধ্বনি সৃষ্টি হয়। এবার মুখগহ্বরের আকার আকৃতির বদল ঘটিয়ে আমরা স্বরতন্ত্রীতে সৃষ্ট স্বরে নানা বৈচিত্র্য নিয়ে আসি। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াতে শ্বাসবায়ু কোথাও এমন বাধা পায় না, যে প্রবাহিত হওয়ার জন্য তাকে ঐ বাধা অতিক্রম করতে হয়। উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে: ধরি, অ এবং আ, এই দুটি স্বর আমরা উচ্চারণ করছি। এই দুই ক্ষেত্রেই ধ্বনির জন্ম হচ্ছে স্বরতন্ত্রীতে। কম্পনের মাত্রাও দুই ক্ষেত্রে প্রায় এক। তাহলে আমরা দুটি আলাদা ধ্বনি শুনছি কেন? এর জন্য দায়ী দুই ক্ষেত্রে মুখবিবরের আলাদা আলাদা আকৃতি। এরকম ভাবে মুখের আকার বদলিয়ে আমরা আরও বেশ কয়েকটি স্বর উচ্চারণ করতে পারি। এখন আশা করি স্বরের জন্ম-প্রক্রিয়া মোটামুটি স্পষ্ট হল।
বাংলা মৌলিক স্বরধ্বনি
বাংলা ভাষায় স্বরধ্বনি কয়টি? এই প্রশ্নটি নিয়ে পড়ুয়াদের মধ্যে যথেষ্ট বিভ্রান্তি আছে। কারণ বাংলা বর্ণমালায় ১১টি স্বর দেখা যায়। কিন্তু এদের মধ্যে সবাই মৌলিক স্বর নয় এবং একটি মৌলিক স্বর(অ্যা) উচ্চারণে থাকলেও বর্ণমালায় নেই। বাংলা ভাষায় মোট স্বরধ্বনির সংখ্যা বলতে হলে মৌলিক ও যৌগিক, উভয় প্রকার স্বরের কথাই বলতে হয়।বাংলায় মৌলিক স্বর ৭টি এবং যৌগিক স্বরের সংখ্যা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। তাই বাংলা স্বরধ্বনির সংখ্যা জানতে চাইলে মৌলিক স্বরের সংখ্যাই বলতে হবে। মৌলিক স্বর ৭টি হল: ই, উ, এ, ও, অ্যা, অ, আ ।
অ্যা স্বরটি উচ্চারণে থাকলেও বাংলা বর্ণমালায় এর জন্য স্বতন্ত্র বর্ণ নেই, 'অ-এ য-ফলায় আ-কার' (অ্যা) দিয়ে একে লেখা হয়। ভবিষ্যতে এর জন্য আলাদা একটি বর্ণ এবং সংক্ষিপ্ত চিহ্ন(বা 'কার') তৈরি হওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি।
বাংলা মৌলিক স্বরধ্বনির বিস্তৃত পরিচয় আমরা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করব।
যৌগিক স্বরধ্বনি :
একাধিক মৌলিক স্বরধ্বনির যোগে যে স্বরগুচ্ছ তৈরি হয়, তাকে যৌগিক স্বরধ্বনি বলে। যৌগিক স্বরধ্বনি সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণা বাংলা ব্যাকরণে চালু আছে।
প্রথম ভুল ধারণা : "বাংলায় যৌগিক স্বরধ্বনি ক'টি ?" এই প্রশ্নের উত্তরে বলি বাংলা বর্ণমালায় মাত্র ২টি যৌগিক স্বর স্থান পেয়েছে। তাদের সংক্ষিপ্ত চিহ্নও (বা 'কার') চালু আছে। ঐ(অ+ই---কৈ) এবং ঔ (বৌ)। কিন্তু প্রকৃত বিচারে এই দুটি ছাড়াও বাংলায় আরও অনেকগুলি যৌগিক স্বর আছে। যেমন : ইএ(ইয়ে), উআ(উয়া), আউ, আও, ওই, উই, আই ইত্যাদি। এগুলি দ্বিস্বর ধ্বনির মধ্যে পড়ে।
দ্বিতীয় ভুল ধারণা: যৌগিক স্বর মাত্রই দুটি স্বরের সমষ্টি। কিন্তু বাস্তবে বাংলাভাষায় দ্বিস্বর ছাড়া ত্রিস্বর, চতুঃস্বর, এমনকি পঞ্চস্বরও উচ্চারিত হয়। এগুলিও যৌগিক স্বর। তাই যৌগিক স্বরের সংখ্যা নিরূপণ করা মুশকিল।
দ্বিস্বর ধ্বনি কাকে বলে?
দুটি স্বরের যোগে গঠিত যৌগিক স্বরকে বলে দ্বিস্বর ধ্বনি। যেমন: ঐ, ঔ, আই, ইউ প্রভৃতি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাষায় ২৫টি দ্বিস্বর চিহ্নিত করেছেন। এদের মধ্যে ঐ এবং ঔ, এই দুটি মাত্র দ্বিস্বরের জন্য আলাদা বর্ণ আছে। অন্য কোনো দ্বিস্বরের আলাদা বর্ণ নেই।
ত্রিস্বরের উদাহরণ : আইআ(আইয়া) যেমন: 'খাইয়া' , 'যাইয়া' প্রভৃতি শব্দে।
চতুঃস্বরের উদাহরণ : আইআই (যেমন: খাইয়াই শব্দে)
পঞ্চস্বরের উদাহরণ: আওআইআ (যেমন: খাওয়াইয়া)।
অর্ধস্বর বা অর্ধ স্বরধ্বনি কাকে বলে
অর্ধস্বর বলতে বোঝায় স্বর ও ব্যঞ্জনের মাঝামাঝি ধ্বনি, ইংরেজিতে যাদের সেমি-ভাওয়েল বলা হয়।
ই, উ, এ, ও এই চারটি স্বর রুদ্ধদলের শেষে থাকলে তখন এদের অর্ধস্বর বা খণ্ড স্বর ('খন্ড স্বর' বানানটি ভুল, ঠিক বানান খণ্ড) বা অর্ধস্বরধ্বনি বলে।
বিষয়টি ভালো করে বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। যখন সাধারণ ভাবে ব্যবহার করা হয়, তখন এই চারটি স্বরকে অর্ধস্বর বলা যাবে না। বিশেষ ধরনের উচ্চারণ হলেই এরা অর্ধস্বর। যেমন: 'খাই', 'যাই', 'সাইবার' প্রভৃতি শব্দের 'ই' অর্ধস্বর, কিন্তু 'ইমন', 'বালিশ', 'বালি' প্রভৃতি শব্দের 'ই' অর্ধস্বর নয়, পূর্ণস্বর। একই ভাবে 'যাও', 'খাও' শব্দের 'ও' অর্ধস্বর, কিন্তু 'গোল' বা 'ওজন' শব্দের 'ও' পূর্ণস্বর। মোটের উপর বলা যায়, যে সব শব্দে এই স্বরগুলির উচ্চারণ আটকে যায়, টেনে উচ্চারণ করা যায় না, সেইসব শব্দে এরা অর্ধস্বর বা খণ্ডস্বর রূপে কাজ করে। এ স্বরটি অর্ধস্বর রূপে কাজ করলে 'য়'-তে পরিণত হয়। যেমন: যা+এ্ = যায়্।
অর্ধস্বর হিসেবে এদের পরিচয় বোঝানোর জন্য এদের নিচে হস্ চিহ্ন দিতে হয়। যেমন: যাই্ , নাউ্ । সাধারণ বানানের ক্ষেত্রে অর্ধস্বর হলেও হস্ দেওয়ার দরকার নেই। যেমন 'বই' শব্দের 'ই্' একটি অর্ধস্বর, তবু 'বই' বানানে হস্ চিহ্ন নেই।
ই, এ স্বর দুটি অর্ধস্বর হিসেবে য়-এর মতো উচ্চারিত হয় এবং উ, ও স্বর দুটি অর্ধস্বর রূপে অন্তঃস্থ ব-এর মতো উচ্চারিত হয়।
ভাষায় স্বরধ্বনির গুরুত্ব
যে কোনো ভাষাতেই স্বরধ্বনিগুলিই ভাষার সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমাদের বাগযন্ত্র শুধু স্বরকেই স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করতে পারে; ব্যঞ্জনকে পারে না। ভাত না থাকলে যেমন তরকারির (তরকারিও 'ব্যঞ্জন') কোনো গুরুত্ব থাকে না, তেমনি স্বর ছাড়া ব্যঞ্জন অচল। স্বরের ঘাড়ে চেপেই ব্যঞ্জনগুলি তাদের উচ্চারণ-বৈতরণী পার হয়। একটি স্বরের ঘাড়ে এক এক সময় তিন-চারটি ব্যঞ্জনও চেপে বসে। উচ্চারণ ক্রিয়াটি তখন আমাদের পক্ষেও গুরুভার হয়ে পড়ে।
যেমন: 'স্ত্রী' শব্দটি দেখতে ছোটোখাটো, কিন্তু এতে একা ঈ-এর ঘাড়ে চেপে আছে স্, ত্, র্, তিনটি ব্যঞ্জন। ইংরাজি Bricks শব্দের মধ্যে একটি স্বর আছে-- ই। ব্যঞ্জন আছে ব্,র্,ক্,স্... মানে ৪টি।
ব্যঞ্জনগুলি আসলে স্বরকেই বৈচিত্র্য প্রদান করে। স্বরের সাথে ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জন মিশ্রিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধ্বনিযূথ গঠন করে। সেই যূথের ভরকেন্দ্রে থাকে স্বর। ব্যঞ্জনের উচ্চারণে সময় লাগে অতি অল্প। সময় যা লাগে তা মূলত ঐ স্বরধ্বনির জন্যই। এই জন্য 'ঈ' বললেও হয় এক মাত্রা আবার 'স্ত্রী' বলললেও এক মাত্রা। (মাত্রা বলতে বোঝায় উচ্চারণ-যোগ্য ন্যূনতম ধ্বনিপরিমাণ বা ধ্বনিগুচ্ছ উচ্চারণ করতে ব্যয়িত সময়)।
হ্রস্বস্বর ও দীর্ঘস্বর
হ্রস্বস্বর কাকে বলে?
যে স্বরকে উচ্চারণ করতে কম সময় ও কম শ্বাসবায়ু লাগে, তাকে হ্রস্বস্বর বলে।
হৃস্বস্বর কোনগুলি?
অ, ই,উ,ঋ - বাংলা বর্ণমালার এই চারটি স্বর হ্রস্বস্বর।
দীর্ঘ স্বর
যে স্বরকে উচ্চারণ করতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ও বেশি শ্বাসবায়ু লাগে তাকে দীর্ঘস্বর বলে।
দীর্ঘস্বর কোনগুলি?
বাংলা বর্ণমালার আ, ঈ,ঊ, এ,ও - এইগুলি দীর্ঘস্বর।
সুতরাং বোঝা গেল বাংলা বর্ণমালায় যে ১১টি স্বর আছে, তার মধ্যে ৫টি দীর্ঘস্বর, ৪টি হ্রস্বস্বর ও ২টি যৌগিক স্বর। তবে মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাষায় দীর্ঘ স্বরের প্রকৃত উচ্চারণ হয় না, সব স্বরই সাধারণ উচ্চারণে হ্রস্বস্বর হিসেবেই উচ্চারিত হয়।
প্লুতস্বর কাকে বলে
স্বরধ্বনির উচ্চারণ যখন প্রলম্বিত বা অতি দীর্ঘ হয়ে যায়, তখন তাকে প্লুতস্বর বলে। সঙ্গীতে ও আহ্বানে প্লুতস্বরের ব্যবহার দেখা যায়।
যেমন: "যদু হেএএএএএএএ, মাছ কিবা?" এখানে 'এ' স্বরটি প্লুতস্বরে পরিণত হয়েছে।
আরও দেখুন
মন্তব্যসমূহ