রূপমূল, রূপ ও সহরূপ | Rup mul | Rup o saha rup

 রূপমূলের ধারণা 


ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি, ভাষার ক্ষুদ্রতম উপাদান হল ধ্বনি। কিন্তু একক ভাবে ধ্বনির সাধারণত কোনো অর্থ থাকে না। এমনটা খুব কম‌ই দেখা যায় যে, একটিমাত্র ধ্বনির সাহায্যেই কোনো অর্থ প্রকাশিত হচ্ছে। তাই একাধিক ধ্বনিকে একসঙ্গে জুড়ে অর্থবহ ধ্বনিগুচ্ছ গঠন করা হয়। তবে ধ্বনিগুচ্ছ মানেই তা রূপমূল নয়। তবে রূপমূল কাকে বলে? 


রূপমূলের সংজ্ঞা


ভাষায় ব্যবহৃত অর্থপূর্ণ একক ধ্বনি অথবা অর্থপূর্ণ ক্ষুদ্রতম ধ্বনিগুচ্ছকে রূপমূল বা রূপিম বলে।


একটিমাত্র ধ্বনি যদি অর্থ প্রকাশে সক্ষম হয়, তবে তা অবশ্য‌ই ক্ষুদ্রতম হবে, ফলে রূপিম‌ও হবে। যেমন: "এ আমার ভাই।" এই বাক্যে 'এ' পদটি একটিমাত্র ধ্বনি নিয়েই গঠিত এবং অর্থপূর্ণ, তাই এটি একটি রূপমূলের উদাহরণ। কিন্তু আগেই বলেছি এমন ধ্বনির সংখ্যা খুব কম। যে কোনো ভাষায় যত রূপমূল দেখা যায়, তার অধিকাংশ‌ই একাধিক ধ্বনির সমষ্টি। উপরোক্ত উদাহরণে 'ভাই' শব্দটিও একটি রূপমূল। কারণ এই শব্দটিকে ভাঙলে আর কোনো ক্ষুদ্রতম অর্থপূর্ণ একক পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ওই উদাহরণে 'আমার' পদটিকে একটি রূপমূল বলা যাবে না। কারণ ওর মধ্যে দুটি অংশ আছে, যথা: 'আমা'**(সর্বনাম) এবং 'র'(বিভক্তি)। অর্থাৎ দেখতে পাচ্ছি এখানে দুটি অর্থপূর্ণ একক পাওয়া যাচ্ছে। তাই এই পদটি দুটি রূপমূলের সমষ্টি‌। 


কোনগুলি রূপমূল? রূপমূলের উদাহরণ:


এক কথায় উদাহরণ দিতে গেলে বলা যায় ভাষায় ব্যবহৃত সমস্ত মৌলিক শব্দ, মৌলিক ধাতু, সমস্ত বিভক্তি, নির্দেশক, সমস্ত প্রত্যয়, সমস্ত উপসর্গ‌ই রূপমূল। মৌলিক শব্দ ও মৌলিক ধাতুগুলি স্বাধীন রূপমূল, অন্যগুলি পরাধীন। মনে রাখতে হবে, সাধিত শব্দ ও সাধিত ধাতুগুলি রূপমূল নয়।


রূপমূল হ‌ওয়ার শর্ত


একটি ধ্বনিগুচ্ছ রূপমূল হবে কিনা তা বিচার করার জন্য ধ্বনিগুচ্ছটি কয়েকটি শর্ত পূরণ করছে কিনা দেখতে হয়। শর্তগুলি নিম্নরূপ


১: ধ্বনিগুচ্ছটিকে ক্ষুদ্রতম অর্থপূর্ণ একক হতে হবে। অর্থাৎ ধ্বনিগুচ্ছটিকে ভাঙলে অন্য কোনো অর্থপূর্ণ একক যেন বেরিয়ে না আসে। 


২: ধ্বনিগুচ্ছটি ভাষায় বার বার ব্যবহৃত হতে হবে। যদিও ক্র্যানবেরি রূপমূলের ক্ষেত্রে এই শর্তের ব্যতিক্রম দেখা যায়। পরে ক্র্যানবেরি রূপমূলের আলোচনায় এই বিষয়টি বিশদে বলছি।


৩: একটি রূপমূলের অংশবিশেষ যেন ধ্বনিগত ও অর্থগত উভয় দিক দিয়ে অন্য কোনো রূপমূলের সাথে মিলে না যায়। যেমন: 'জলাশয়' শব্দের দুটি অংশ 'জল' ও 'আশয়' - এই দুটি অংশ‌ই অর্থপূর্ণ। ফলে 'জলাশয়' শব্দটিকে একটি রূপমূল বলা যাবে না।


রূপমূলের শ্রেণিবিভাগ


ভাষায় দুই ধরনের রূপমূল দেখা যায়। স্বাধীন বা মুক্ত রূপমূল ও পরাধীন বা বদ্ধ রূপমূল।


স্বাধীন বা মুক্ত রূপমূলের ধারণা ও উদাহরণ


যে রূপমূলগুলি ভাষায় স্বাধীন ভাবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং যাদের অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট ও স্বতন্ত্র, তাদের স্বাধীন রূপমূল বলে। সমস্ত মৌলিক শব্দ ও মৌলিক ধাতুই স্বাধীন রূপমূলের উদাহরণ।


পরাধীন বা বদ্ধ রূপমূলের ধারণা ও উদাহরণ


যে রূপমূলগুলি অন্য কোনো রূপমূলের আশ্রয় ছাড়া ভাষায় ব্যবহৃত হতে পারে না, তাদের বলে পরাধীন বা বদ্ধ রূপমূল। বিভক্তি, নির্দেশক, প্রত্যয়, উপসর্গগুলি বদ্ধ রূপমূলের উদাহরণ। এছাড়া কিছু কৃদন্ত পদ আছে, যাদের বদ্ধ রূপমূলের মধ্যে ফেলা উচিত, এরা একক ভাবে ভাষায় ব্যবহৃত হতে পারে না। যেমন: 'পঙ্কজ' শব্দের 'জ' একটি অর্থবহ রূপমূল কিন্তু ভাষায় একক ভাবে ব্যবহার করা যায় না।


ক্র্যানবেরি রূপমূল


ক্র্যানবেরি রূপমূল হল এমন এক ধরনের পরাধীন রূপমূল, যা ভাষায় বার বার ব্যবহৃত হয় না। বিশেষ কোনো একটি রূপমূলের আশ্রয়েই ব্যবহৃত হয়‌। ক্র্যানবেরি রূপমূলের অর্থ‌ও ঐ বিশিষ্ট শব্দের সঙ্গে যুক্ত অবস্থাতেই বোঝা যায়। ইংরেজি 'ক্র্যানবেরি' শব্দের 'ক্র্যান' অংশটি এমন‌ই এক রূপমূল। এর একটি অর্থ তো আছে কিন্তু শব্দটি শুধুমাত্র 'বেরি' শব্দের সাথেই ব্যবহৃত হয়। পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের ব‌ইয়ে ক্র্যানবেরি রূপমূলের যে উদাহরণগুলি দেওয়া আছে (আলাপ, বিলাপ, প্রলাপ ইত্যাদি) ওগুলি ঠিক নয়। এইসব শব্দের 'লাপ' অংশটি সংস্কৃত √লপ্ ধাতু থেকে এসেছে। তাছাড়া এগুলি একাধিক উপসর্গের সাথে যুক্ত হয়। ক্র্যানবেরি রূপমূলের অপর নাম অনন্যসাধারণ রূপমূল‌। 




রূপ, রূপমূল ও সহরূপ


এই তিনটি পরিভাষা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মনে বিভ্রান্তির শেষ নেই। আজকের আলোচনায় এই বিভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা করবো। প্রথমেই আমরা জেনে নেবো রূপমূল ও সহরূপ কী।


একটি রূপমূলের যদি একাধিক রূপভেদ থাকে অথচ এক‌ই অর্থ হয় এবং একটি রূপভেদকে অন্য রূপভেদের স্থানে ব্যবহার করা না যায়, তবে ঐ রূপভেদগুলিকে বলা হবে সহরূপ। সহরূপ স্বাধীন বা পরাধীন, উভয় রূপমূলের‌ই থাকতে পারে।


স্বাধীন রূপমূলের সহরূপ: আমরা জানি, সর্বনাম পদের দুটি আকৃতি দেখা যায়: একটি বিভক্তি ছাড়া রূপ ও অন্যটি বিভক্তিগ্রহণকারী রূপ**। যেমন: "আমি ভাত খাই।"-- বাক্যে 'আমি' সর্বনামটির যে রূপ দেখা যাচ্ছে, "আমাকে ভাত দাও।"-- বাক্যে সেই চেহারা নেই। আমি>আমা হয়ে গেছে। এই 'আমি' ও 'আমা' এক‌ই রূপমূলের দুটি সহরূপ। এবার লক্ষ করলে দেখা যাবে কোনো বাক্যে 'আমি'-র স্থানে 'আমা' অথবা 'আমা'-র স্থানে 'আমি' ব্যবহার করা যায় না। অর্থাৎ 'আমিকে ভাত দাও" বা "আমা ভাত খাই" -- এমনটা দেখা যায় না। এই পরিস্থিতিকে বলা হয় পরিপূরক অবস্থান, এ এক এমন অবস্থান, যেখানে একে অন্যের স্থান নিতে পারে না।


পরাধীন রূপমূলের সহরূপ: বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত নির্দেশক 'টি'-এর একাদিক সহরূপ আছে, যথা: টা, টে, টো। 'খানি' নির্দেশকের‌ও একাধিক রূপমূল আছে, যথা: খান, খানা। 


সহরূপ ও মূলরূপ সম্পর্কে একটি কথা মনে রাখতে হবে। তা হল: মূলরূপটি হল সহরূপগুলির সমষ্টি বা পরিবার। অর্থাৎ 'আমি' ও 'আমা', এই দুটিই সহরূপ। এদের মূলরূপ হল 'আমি'। আবার 'টি', 'টা', 'টে', 'টো', এরা সবাই সহরূপ এবং এদের মূলরূপ হল 'টি'। 


মূলরূপ, রূপ ও সহরূপের তুলনা

এখন জানা বাকি র‌ইলো রূপ কাকে বলে? এর উত্তরে বলি: সমস্ত মূলরূপ ও সমস্ত সহরূপ‌ই হল রূপ। শুধুমাত্র রূপ বললে একসঙ্গে সবাইকে বোঝায়। 


অর্থাৎ সমস্ত মূলরূপ‌ই রূপ কিন্তু সব রূপ মূলরূপ নয় 

আবার 

সব সহরূপ‌ই রূপ কিন্তু সব রূপ‌ই সহরূপ নয়। 

আমাকে YouTube-এ সাবস্ক্রাইব করার জন্য এখানে ক্লিক করুন।

** সর্বনামের বিভক্তিগ্রাহী রূপ। বিষয়টি জানার জন্য সর্বনাম পদের আলোচনা পড়ে নিন।

আর‌ও পড়ুন

বাংলা ব্যাকরণের সেরা ব‌ই 

প্রত্যয়ের বিস্তারিত আলোচনা

মূলধ্বনি ও সহধ্বনি

বাক্য ও তার শ্রেণিবিভাগ

সূচিপত্র


মন্তব্যসমূহ

kishor বলেছেন…
অত্যন্ত স্পষ্ট ধারণা হল ।
Souvik Panda বলেছেন…
পাঠক স্যার,আমি আপনার নিয়মিত পাঠক। লেখা এবং বোঝানো এত প্রাঞ্জল যে,খুব উপকার হয় আমার।
সব রূপমূলই রূপ কিন্তু সব রূপ রূপমূল নয়,কিংবা সব সহরূপই রূপ,কিন্তু সব রূপ সহরূপ নয় - এটা বুঝতে পারছি না। সব রূপমূলই রূপ কিংবা সব সহরূপই রূপ,এটা বুঝছি,কিন্তু পরের বাক্যাংশগুলো বুঝতে পারছি না।দয়াকরে উদাহরণ দিয়ে আরেকবার যদি বুঝিয়ে দেন,উপকৃত হই। ধন্যবাদ।

আর‌ও পড়ে দেখুন

তির্যক বিভক্তি কাকে বলে

লোকনিরুক্তি কাকে বলে

মিল যুক্ত শব্দ | মিল করে শব্দ লেখ

অপিনিহিতি কাকে বলে

অভিশ্রুতি কাকে বলে?

ধ্বনি ও বর্ণের মধ্যে পার্থক্য

নিরপেক্ষ কর্তা কাকে বলে

বিভাজ্য ধ্বনি কাকে বলে | অবিভাজ্য ধ্বনি কাকে বলে