সমাস: সাধারণ ধারণা, দ্বন্দ্ব ও তৎপুরুষ | Somas
সমাসের সংজ্ঞা ও ধারণা
'সমাস' কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল সংক্ষেপ বা সংক্ষেপকরণ। আমরা কথা বলার সময় ভাষাকে সংক্ষিপ্ত ও সুন্দর করার উদ্দেশ্যে অর্থসম্পর্কযুক্ত একাধিক পদকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়েছি। এর ফলে একদিকে ভাষার সংক্ষেপ যেমন হয়, তেমনি শব্দভাণ্ডারে নতুন শব্দের সমাগম ঘটে। ভাষা সমৃদ্ধ হয়। এই জুড়ে দেওয়ার কাজটিই সমাস নামে পরিচিত। এখানে অর্থসম্পর্ক বলতে কী বোঝায় তা স্পষ্ট করা দরকার। যদি আমি 'ফুটবল' ও 'মাঠ' এই দুটি পদের কথা বলি তাহলে সবার মনেই ফুটে উঠবে একটি খেলা ও একটি মাঠের ছবি। এই বিশেষ খেলাটি মাঠেই হয়। এবার আমি যদি পদদুটিকে জুড়ে দিই, বলি 'ফুটবল-মাঠ' তাহলে বোঝা যাবে, আমি বলছি "ফুটবল খেলার মাঠ"। ফুটবল খেলা মাঠে হয় বলেই এদের মধ্যে একটা যোগ আছে অথবা বলতে পারি, পদ দুটির অর্থের মধ্যে যোগ আছে। কিন্তু অন্য পদ নিলে কী হবে? ধরা যাক আমি এবার 'রাস্তা' পদটি নিলাম। 'ফুটবল' ও 'রাস্তা'। এই পদদুটির মধ্যে এরূপ কোনো যোগ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একই ভাবে 'আকাশ' ও 'মাটি' পদদুটির মধ্যেও সম্পর্ক নেই। তবে মনে রাখতে হবে, সম্পর্ক থাকলেই সমাস হবে এমন কোনো কথা নেই।
সুতরাং আমরা বলতে পারি: অর্থসম্পর্কযুক্ত একাধিক পদকে একপদে পরিণত করার প্রক্রিয়াকে বলে সমাস।
সমাসের পরিভাষাসমূহ
সমস্যমান পদ:
সমাসে যে পদগুলি মিলিত হয় তাদের সমস্যমান পদ বলে।
যেমন: রাজার পুত্র = রাজপুত্র; এখানে সমস্যমান পদ দুটি হল 'রাজার' ও 'পুত্র'।
সমস্তপদ:
সমাসে সমস্যমান পথগুলির মিলনের ফলে যে নতুন পদটি তৈরি হয় তাকে সমস্তপদ বলে।
উপরের উদাহরণে 'রাজপুত্র' সমস্তপদ।
ব্যাসবাক্য:
সমাসের সমস্যমান পদগুলির মধ্যে অর্থের সম্পর্ক থাকে। এই অর্থসম্পর্কটি যে বাক্যাংশের দ্বারা বিশ্লেষণ করা হয় তাকে ব্যাসবাক্য বলে।
যেমন: সিংহ চিহ্নিত আসন = সিংহাসন; এখানে সিংহ ও আসন-এর মধ্যে কী ধরনের সম্পর্ক আছে, তা ভেঙে দেখানো হয়েছে "সিংহ চিহ্নিত আসন" বাক্যাংশের দ্বারা। তাই এটি ব্যাসবাক্য । ব্যাস কথার অর্থ হল বিশ্লেষণ করা বা ভাঙা। সমাস শব্দের বিপরীতার্থক শব্দ ব্যাস।
পূর্বপদ ও পরপদ:
সমস্যমান পদগুলির মধ্যে যেটি ব্যাসবাক্যে আগে আসে, সেটি পূর্বপদ ও যেটি পরে আসে, সেটি পরপদ।
এখানে মনে রাখতে হবে, পূর্বপদ ও পরপদ নির্ণয়ের জন্য ব্যাসবাক্য দেখতে হবে, সমস্তপদ নয়। তবে এর কিছু ব্যতিক্রম আছে, তা যথাস্থানে আলোচনা করা হবে।
সমাসের শ্রেণিবিভাগ:
সমাসের শ্রেণিবিন্যাস করা হয় মূলত সমস্যমান পদগুলির প্রকৃতি, তাদের মিলনের বৈশিষ্ট্য ও মিলনের পর কোন পদটির অর্থপ্রাধান্য তৈরি হল তার উপর ভিত্তি করে। এক্ষেত্রে অর্থপ্রাধান্যের ভিত্তিটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অর্থপ্রাধান্য অনুসারে একটি প্রাথমিক শ্রেণিবিন্যাস করতে পারি এই ভাবে:
১: উভয়পদ-প্রধান (দ্বন্দ্ব)
২: পরপদ-প্রধান(তৎপুরুষ, কর্মধারয়, দ্বিগু)
৩: পূর্বপদ-প্রধান (অব্যয়ীভাব) ও
৪: অন্যপদ-প্রধান(বহুব্রীহি)
আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অর্থ-সম্পর্কের ভিত্তিতে তিন ভাগে ভাগ করেছেন: সংযোগমূলক, আশ্রয়-মূলক ও বর্ণনা-মূলক।
দ্বন্দ্ব সমাস
যে সমাসে সমস্যমান পদগুলির প্রত্যেকটির অর্থ সমস্তপদে সমান ভাবে প্রাধান্য পায়, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে।
উদাহরণ: পিতা পুত্র = পিতা ও পুত্র, রাজারাণী = রাজা ও রাণী, ঘরবাহির = ঘর ও বাহির, সুখ-দুঃখ = সুখ ও দুঃখ, দেশকাল = দেশ ও কাল, দম্পতি = জায়া ও পতি, আমরা = আমি, তুমি ও সে, পথে-প্রবাসে = পথে ও প্রবাসে, বনে-বাদাড়ে = বনে ও বাদাড়ে প্রভৃতি।
উদাহরণগুলো লক্ষ করলেই বোঝা যাবে সমস্তপদ গঠিত হওয়ার পরেও সমস্যমান পদগুলির প্রত্যেকটির অর্থ অক্ষুণ্ন আছে, অর্থাৎ কেউ বেশি প্রাধান্য পায়নি।
প্রকারভেদ
১: সমার্থক দ্বন্দ্ব: এই দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্যমান পদগুলি সমার্থক বা প্রায় সমার্থক হয়। যেমন: ঘরবাড়ি, বনজঙ্গল, বনবাদাড়, ঝোপজঙ্গল, নদীনালা, খালবিল, গ্রামগঞ্জ ইত্যাদি।
২: বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব: এক্ষেত্রে সমস্যমান পদগুলি বিপরীতার্থক হয়। যেমন: উঁচু-নিচু, ছোটোবড়ো, ঘর-বাহির, দেশ-বিদেশ, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি।
৩: সহচর দ্বন্দ্ব: দ্বন্দ্ব সমাসের সমস্যমান পদগুলি প্রায়শই সহাবস্থান করলে বা কাছাকাছি থাকলে তাকে সহচর দ্বন্দ্ব বলে। যেমন: বইখাতা, কাগজ-কলম, পিতা-মাতা, পশুপাখি, গোরুবাছুর, খাট-বিছানা ইত্যাদি।
৪: একশেষ দ্বন্দ্ব: যে দ্বন্দ্ব সমাসের সমস্তপদটি একটিমাত্র সমস্যমান পদের বহুবচনের রূপের সাহায্যে গঠিত হয়, তাকে একশেষ দ্বন্দ্ব বলে।
যেমন: আমি, তুমি ও সে = আমরা, তুমি ও সে = তোমরা ইত্যাদি।
একশেষ দ্বন্দ্ব সমাসের উদাহরণ বেশি পাওয়া যায় না। একটিমাত্র পদ 'শেষ' বা অবশিষ্ট থাকে বলেই এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছে।
তৎপুরুষ সমাস
'তৎপুরুষ' কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো 'তার পুরুষ'। এটি একটি সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত ভাষায় এটি একটি সমাসবদ্ধ শব্দ এবং 'তৎপুরুষ' শব্দটি তৎপুরুষ সমাসের একটি আদর্শ উদাহরণ। এই উদাহরণটিকেই সমাসটির নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সংস্কৃত সমাসের নামকরণের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি একাধিক সমাসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। বহুব্রীহি ও দ্বিগু সমাসের নামকরণও একই ভাবে হয়েছে। এই উদাহরণ দুটিও ওই দুই সমাসের আদর্শ উদাহরণ।
তৎপুরুষ সমাসের সংজ্ঞা: যে সমাসের সমস্তপদে পূর্বপদের বিভক্তি (এবং অনুসর্গ) লোপ পায় ও পরপদের অর্থ প্রাধান্য লাভ করে, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে।
তৎপুরুষ সমাসের শ্রেণিবিভাগ
সাধারণ ভাবে তৎপুরুষ সমাসের শ্রেণিবিভাগ করা হয় পূর্বপদের লুপ্ত বিভক্তি ও অনুসর্গ অনুসারে। অর্থাৎ পূর্বপদের যে কারকের বিভক্তি বা অনুসর্গ লোপ পায়, সেই কারকের নামে তৎপুরুষ সমাসের নামকরণ করা হয়। নিচে কারক ও তার সংশ্লিষ্ট বিভক্তির একটি তালিকা দেওয়া হলো:
কর্তৃ কারক - শূন্য বিভক্তি
কর্ম কারক - কে বিভক্তি
করণ কারক - দ্বারা, দিয়ে অনুসর্গ
নিমিত্ত কারক - জন্য, নিমিত্ত অনুসর্গ
অপাদান কারক - হইতে, থেকে, চেয়ে, অপেক্ষা অনুসর্গ
সম্বন্ধ পদ (অকারক) - র, এর, দের বিভক্তি
অধিকরণ কারক - এ, য়, তে বিভক্তি
মনে রাখতে হবে, কর্তৃ কারকে বিভক্তি শূন্য হয়(তির্যক বিভক্তি হলে শূন্য হয় না কিন্তু সমাস করার সময় তির্যক বিভক্তি ব্যবহার করা চলে না)। তাই পূর্বপদে কর্তার বিভক্তি লোপ হয় না এবং এই কারণে কর্তৃ তৎপুরুষ সমাস সংস্কৃত ভাষায় নেই। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলায় কর্তৃ তৎপুরুষ সমাসের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন কিন্তু তা পরবর্তী সময়ে প্রচলিত হয়নি। আমরা কর্তৃ তৎপুরুষ সমাসের আলোচনা করবো না।
১:কর্ম তৎপুরুষ: পূর্বপদে কর্ম কারকের 'কে' বিভক্তি লোপ পায় তাকে কর্ম তৎপুরুষ বলে।
যেমন: গাছকাটা, লুচিভাজা, কলাবেচা, রথদেখা, ভাত খাওয়া, বইপড়া ইত্যাদি।
মনে রাখতে হবে, এই সমাসে ব্যাসবাক্য করার সময় প্রযুক্ত বিভক্তি কৃত্রিম মনে হবে। বোঝার স্বার্থে এমন করতে হয়। আসলে বাংলায় মুখ্য কর্মে শূন্য বিভক্তি সমধিক প্রচলিত।
যেমন: দা দিয়ে কাটা= দাকাটা।
হাত দিয়ে বোনা = হাতবোনা
শর দ্বারা বিদ্ধ = শরবিদ্ধ
গুণ দ্বারা হীন = গুণহীন
৩: নিমিত্ত তৎপুরুষ : নিমিত্ত কারকের অনুসর্গ লোপ পায়।
যেমন: রান্নার জন্য ঘর = রান্নাঘর
একই ভাবে: স্নানঘর, শিকারযাত্রা, স্নানযাত্রা,
৪: অপাদান তৎপুরুষ: অপাদান কারকের অনুসর্গ লোপ পায়।
যেমন: বিলাত থেকে ফেরত = বিলাতফেরত
স্বর্গ থেকে ভ্রষ্ট = স্বর্গভ্রষ্ট , শাখা থেকে চ্যুত = শাখাচ্যুত, ব্যাঘ্র থেকে ভীত = ব্যাঘ্রভীত, মুখ থেকে নিঃসৃত = মুখনিঃসৃত ইত্যাদি।
৫: সম্বন্ধ তৎপুরুষ: সম্বন্ধ পদের বিভক্তি লোপ পায়।
যেমন: গঙ্গার জল = গঙ্গাজল, রাজার পুত্র = রাজপুত্র, দেশের আচার = দেশাচার, গৃহের অভ্যন্তর = গৃহাভ্যন্তর ইত্যাদি।
৬: অধিকরণ তৎপুরুষ: অধিকরণের বিভক্তি লোপ পায়।
যেমন: গাছে পাকা = গাছপাকা, গৃহে পালিত = গৃহপালিত,
বনে বাস = বনবাস, দুঃখে মগ্ন = দুঃখমগ্ন, বাক্-এ পটু = বাক্পটু ইত্যাদি।
৭: নঞ্ তৎপুরুষ : যে তৎপুরুষ সমাসের পূর্বপদে না বাচক 'নয়' শব্দ থাকে তাকে নঞ্ তৎপুরুষ বলে।
যেমন: নয় চল = অচল, নয় শুদ্ধ = অশুদ্ধ
৮: উপপদ তৎপুরুষ: উপপদ তৎপুরুষ সমাস বোঝার আগে বুঝে নিতে হবে উপপদ কী। সংস্কৃত ভাষায় একটি উপসর্গ ও একটি ধাতুর পরে কৃৎ প্রত্যয় যোগ করে শব্দ গঠনের ব্যাপক প্রচলন ছিল।
ঐ শব্দগুলির গঠন এরকম: উপসর্গ+ধাতু+কৃৎ প্রত্যয়।
যেমন: বি-√হৃ+ঘঞ্ = বিহার। (লক্ষণীয়: √হৃ+ঘঞ্=হার। এই হার পদটি একক ভাবে ভাষায় ব্যবহৃত হয় না।)
(ধাতু+কৃৎ) - এই অংশটিকে একত্রে কৃদন্ত পদ বলে। কৃদন্ত পদগুলির মধ্যে যেগুলি উপসর্গের আশ্রয় গ্রহণ না করে স্বাধীন ভাবে ব্যবহৃত হয় না সেই কৃদন্ত পদগুলি অনেক সময় উপসর্গের পরিবর্তে বিশেষ্য বা বিশেষণ পদের আশ্রয়েও নতুন শব্দ গঠন করে ও ভাষায় ব্যবহার-যোগ্য হয়ে ওঠে। এরূপ পরাধীন কৃদন্ত পদের আশ্রয়দাতা নামপদকে উপপদ বলে। উপপদের সঙ্গে কৃদন্ত পদের সমাসকে বলে উপপদ তৎপুরুষ সমাস।
উদাহরণ: জলদ (জল দান করে যে) , পাদপ (পা দিয়ে পান করে যে), গৃহবাসী (গৃহে বাস করে যে), মোক্ষদা (মোক্ষ দান করেন যিনি), শুভঙ্কর (শুভ করে যে), পঙ্কজ (পঙ্কে জন্মে যা) । লক্ষ করলে দেখা যাবে এখানে পূর্বপদের বিভক্তি লুপ্ত হয়েছে প্রতি ক্ষেত্রেই। শুধু মুখ্য কর্মে বাংলায় শূন্য বিভক্তি ব্যবহৃত হয় বলে কর্মের বিভক্তি লোপ বোঝা যাচ্ছে না। উপপদ তৎপুরুষ সমাসের বিস্তারিত আলোচনা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
আমাকে YouTube-এ ফলো করার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ