বাক্য পরিবর্তনের নিয়ম
বাক্য পরিবর্তনের মূল নীতি
বাক্য পরিবর্তনের কয়েকটি মূল নীতির কথা বলে আজকের আলোচনা শুরু করবো।
১: বাক্য পরিবর্তন করার ফলে বাক্যের বক্তব্য যেন বদলে না যায়। মূল বাক্যে বক্তা যা বলতে চাইছে, বাক্য পরিবর্তনের পর সেই ভাবটিই বোঝাবে।
২: বাক্যের ক্রিয়ার কালটি বদলানো চলবে না। মূল বাক্যের ক্রিয়ার কাল পরিবর্তিত বাক্যে অক্ষুণ্ন থাকবে।
৩: বাক্যের সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা বাক্য পরিবর্তনের ফলে ক্ষুণ্ন হতেও পারে। তবে যতটা সম্ভব ব্যঞ্জনা অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করা উচিত।
৪: বাক্য পরিবর্তনের ফলে ক্রিয়ার ভাব বদলে যেতে পারে।
৫: নির্দেশক বাক্যে দাঁড়ি চিহ্ন, প্রশ্নসূচক বাক্যে জিজ্ঞাসা চিহ্ন, আবেগসূচক বাক্যে আবেগচিহ্ন অপরিহার্য।
৬: বাক্য পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন বোধে যে কোনো নতুন শব্দ নিয়ে আসা যাবে, শুধু খেয়াল রাখতে হবে বাক্যের মূল ভাব যেন বদলে না যায়।
বাক্য পরিবর্তনের নিয়ম
"আমি যাঁকে চিনি, তিনি একজন ডাক্তার।" এটি একটি জটিল বাক্য। একে সরল বাক্যে পরিণত করতে বলা হলে দু ভাবে করা যাবে। একটি নির্ভুল, কিন্তু অপরটি ব্যাকরণগত ভাবে শুদ্ধ নয়।
১: আমি একজন ডাক্তারকে চিনি।
২: আমার চেনা লোকটি একজন ডাক্তার।
এখন প্রশ্ন হল, কোনটি ঠিক? কোনটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল? জটিল বাক্যের গঠন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে বোঝা যাবে যে, প্রথম বাক্যটি সরল বাক্য হলেও আমাদের আলোচ্য বাক্যের সম্পূর্ণ সমার্থক নয়। কারণ জটিল বাক্যটিতে প্রধান খণ্ডবাক্য "তিনি একজন ডাক্তার।" সরল বাক্যে এই অংশের বিধেয়টিকে অপরিবর্তিত না রাখলে বাক্য দুটির ভাব এক থাকবে না। ২ নং উত্তরটিতে কিন্তু কোনো ভুল নেই। "আমি যাঁকে চিনি"- একটি বিশেষণধর্মী খণ্ডবাক্য। সরল বাক্যে 'আমার চেনা' বাক্যাংশটিও বিশেষণের কাজ করছে।
সুতরাং বোঝা গেলো, জটিল বাক্য থেকে সরল বাক্য এবং সরল বাক্য থেকে জটিল বাক্যে রূপান্তর করার সময় প্রধান খণ্ডবাক্য কোনটি তা মাথায় রাখতে হবে এবং প্রধান খণ্ডবাক্যের বিধেয়টিকে সরল বাক্যে অপরিবর্তিত রাখতে হবে। এ ছাড়া, অপ্রধান খণ্ডবাক্যটি জটিল বাক্যে যে ভূমিকা পালন করছে, সরল বাক্যের মধ্যে তাকে সেই ভূমিকাতেই রাখতে হবে। অর্থাৎ বিশেষ্যধর্মী খণ্ডবাক্যকে বিশেষ্যধর্মী বাক্যাংশ বা বিশেষ্য পদেই পরিণত করতে হবে। বিশেষণ ও ক্রিয়াবিশেষণধর্মী খণ্ডবাক্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
এ বার আসি জটিল ও যৌগিক বাক্যের রূপান্তরে। এই অংশটি অপেক্ষাকৃত সহজ। আমরা জানি, জটিল বাক্যের মধ্যে স্বাধীন খণ্ডবাক্য একটিই থাকবে, থার সাথে থাকবে এক বা একাধিক অপ্রধান বা অধীন খণ্ডবাক্য। জটিল বাক্য থেকে যৌগিক বাক্যে রূপান্তরিত করার জন্য অধীন খণ্ডবাক্যটিকে একটি স্বাধীন সরল বাক্যের রূপ দিতে হবে, এবং তারপর কমা চিহ্ন অথবা উপযুক্ত সমুচ্চয়ী অব্যয় মাঝে বসিয়ে প্রধান খণ্ডবাক্যটি স্থাপিত করতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে উল্টোটাও হতে পারে, অর্থাৎ প্রধান খণ্ডবাক্য আগে বসবে, তারপর বসবে অপ্রধান খণ্ডবাক্য থেকে রূপান্তরিত সরল বাক্যটি।
যেমন:
জটিল: যদি তুমি যাও, তাহলে আমি যাবো।
সরল: তোমাকে যেতে হবে, তবেই আমি যাবো।
জটিল: যারা হোমওয়ার্ক করোনি, তারা বেরিয়ে যাও।
যৌগিক: কয়েকজন হয়তো হোমওয়ার্ক করোনি, তারা বেরিয়ে যাও।
বাক্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন: বাক্যের গঠন ও শ্রেণিবিভাগ।
এবার দেখে নিই বাক্যের অর্থগত শ্রেণিবিভাগের রূপান্তর
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিভিন্ন ধরনের বাক্যকে নির্দেশক বাক্যে পরিণত করা। নির্দেশক বাক্য এমন এক ধরনের বাক্য, যার প্রকাশ ক্ষমতা অসীম। এই কারণে যে কোনো ধরনের অন্তর্গত প্রায় সব বাক্যকেই নির্দেশক রূপ দেওয়া যায়। নির্দেশক বাক্যে রূপান্তর করার আগে জেনে নিতে হবে নির্দেশক বাক্য আসলে কী। নির্দেশক বাক্যের নামটি সামান্য বিভ্রান্তিকর। এর নাম বিবৃতি-বাক্য হলে ভালো হতো। কারণ এই বাক্যের কাজ হলো বিবরণ দেওয়া। যে কোনো ধরনের ভাবকেই বিবরণের আকৃতি দেওয়া সম্ভব। যেমন:(ক) "তোমার নাম কী?" একটি প্রশ্ন, অথচ এই কথাটিকেই যদি ঘুরিয়ে বলি,(খ) "তোমার নাম জানতে চাইছি।" তাহলে আমার চাওয়ার বিবরণ দেওয়া হলো। "আমি কলেজ স্ট্রিট যাচ্ছি।" আর "আমি তোমার নাম জানতে চাইছি।" - এই দুটি বাক্যের ভাবপ্রকাশের ধরনে কোনও ফারাক নেই। দুটিই নির্দেশক বাক্য। ক-বাক্যে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, বক্তার ইচ্ছের বিবরণ দেওয়া হয়নি। অপরদিকে খ-বাক্যে সরাসরি প্রশ্ন না করে বক্তা নিজের ইচ্ছের কথাটি বিবৃত করল। ঠিক একই ভাবে "আমাকে খেতে দাও।" বললে অনুরোধের ভাব প্রকট হয়, কিন্তু যদি বলা হয় "আমি খেতে চাইছি।" তাহলে অনুরোধ থাকলো না, বক্তার চাওয়ার বিবরণ দেওয়া হলো। "তুমি বেরিয়ে যাও।" বললে যে ভাবে আদেশের সুর ফুটে ওঠে, "তোমাকে বেরিয়ে যেতে বলছি।" বললে আদেশ আর সরাসরি হয় না, বক্তা কী বলছে, তার বিবরণ হয়ে যায়।
আবেগসূচক বাক্য থেকে নির্দেশক বাক্য
বিস্ময়সূচক বা আবেগসূচক বাক্যকে নির্দেশক বাক্যে রূপান্তরিত করার জন্য আবেগের ভাবটি প্রশমিত করে বাক্যটিকে সরল বিবৃতিতে পরিণত করতে হবে। যেমন: "কী বড় সাপ!" বললে বক্তার বিস্ময়ের স্ফুরণ ঘটলো, কিন্তু যদি বলা হয়, "সাপটি খুব বড়ো।" তাহলে বিস্ময় অপগত হলো, বাক্যটি একটি সাধারণ বিবৃতিতে পরিণত হলো, হয়ে পড়লো নির্দেশক বাক্য। আবেগসূচক বাক্যকে নির্দেশক বাক্যে পরিণত করার সময় আবেগসূচক অব্যয় থাকলে সেটি বাদ দিতে হবে। নির্দেশক বাক্যের মধ্যে আবেগসূচক অব্যয়ের জন্য উপযুক্ত জায়গা পাওয়া যায় না।
প্রার্থনাসূচক বাক্য থেকে নির্দেশক বাক্য
প্রার্থনাসূচক বাক্য থেকে নির্দেশক বাক্য করার জন্য 'কামনা করছি', 'আশা করছি', 'প্রার্থনা করছি' প্রভৃতি শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে হবে। এর সাথে ক্রিয়াটিকেও বদলে নিতে হতে পারে। যেমন
প্রার্থনা: "তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।"
নির্দেলক: "তোমার দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।"
প্রার্থনা: "ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন "
নির্দেশক: "ঈশ্বরের কাছে তোমার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করি।"
শর্তসাপেক্ষ বাক্য থেকে নির্দেশক বাক্য
শর্তসাপেক্ষ বাক্য থেকে নির্দেশক বাক্যে রূপান্তরিত করার জন্য শর্তের ভাবটিকে গৌণ করে দিতে হবে, বিবরণের ভাবটিকে প্রাধান্য দিতে হবে। শর্তটিকে ক্রিয়াবিশেষণের রূপ দিলে বাক্যটি অনেকটাই বিবৃতিমূলক হয়ে ওঠে। সে জন্য ইলে-প্রত্যয়ান্ত অসমাপিকা ক্রিয়াটির বিলোপ ঘটাতে হবে। তবে শর্তের ভাবটি সবসময় পুরোপুরি চাপা পড়ে না।
শর্তসাপেক্ষ: তুমি এলে আমি যাবো।
নির্দেশক: তোমার আসার পর আমি যাবো।
শর্তসাপেক্ষ: সকাল হলেই পাখিরা ডাকবে।
নির্দেশক: সকাল হওয়ার পর পাখিরা ডাকবে।
শর্তসাপেক্ষ: মন দিয়ে পড়াশোনা করলে সফল হবে।
নির্দেশক: মন দিয়ে পড়াশোনা করার মাধ্যমেই সফল হবে।
সন্দেহবাচক থেকে নির্দেশক বাক্য
এরপর আসি সন্দেহবাচক থেকে নির্দেশক বাক্যের রূপান্তরে। সন্দেহবাচক বাক্য থেকে নির্দেশক বাক্যে রূপান্তর করার প্রয়োজন আদৌ কতটা রয়েছে সে নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তবু ব্যাকরণগত ভাবে রূপান্তর করা সম্ভব। সে রকম দু একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
সন্দেহবাচক: পাছে কেউ দেখে ফেলে!
নির্দেশক: কেউ দেখে ফেলার সম্ভাবনা আছে।
হ্যাঁ বাচক বাক্য ও না বাচক বাক্যের রূপান্তর
ইতিবাচক ও নেতিবাচক বাক্য নিয়ে অনেকের মনেই বিভ্রান্তি আছে। যেমন, আমি দেখেছি "এখানে এমন কেউ নেই যে প্রসাদ পায়নি।" এই বাক্যটিকে কেউ কেউ ইতিবাচক বাক্য বলেছেন। এটি মারাত্মক ভ্রান্তি। দুটি না বাচক শব্দ দিয়ে ইতিবাচক বাক্য গঠন করা যায় না, বরং ইতিবাচক ভাব থেকে নেতিবাচক বাক্য গঠন করার জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। মনে রাখতে হবে, ইতিবাচক বাক্যের কোনো ক্রিয়াপদ না বাচক 'নহ্' ধাতু নিষ্পন্ন হলে চলবে না এবং কোনো ক্রিয়াতে নিষেধাত্মক অব্যয় থাকা চলবে না। মোট কথা: নেতিবাচক বাক্য থেকে ইতিবাচক বাক্য করার জন্য প্রতিটি নেতিবাচক ও নিষেধাত্মক পদ বিলুপ্ত করতে হবে। তবে বাক্যের ভাবটি অপরিবর্তিত রাখতে হবে। যেমন:
নেতিবাচক: আমি যাবো না।
ইতিবাচক: আমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব।
নেতিবাচক: ছেলেটি মন দিয়ে পড়াশোনা করে না।
ইতিবাচক: ছেলেটি পড়াশোনায় অবহেলা করে।
আলোচক: অনন্য পাঠক, SLST Bengali Coach.
মন্তব্যসমূহ