প্রতিবেদন রচনার নিয়ম | Protibedon rachonar niyom

 প্রতিবেদন কাকে বলে?

প্রতি+বেদন= প্রতিবেদন। বেদন কথার অর্থ জ্ঞাপন, প্রতি উপসর্গটি অভিমুখ বোঝায়। অর্থাৎ প্রতিবেদন কথার অন্তর্নিহিত অর্থ হল, নির্দিষ্ট পাঠক-শ্রেণির কথা মাথায় রেখে তাঁদের অভিমুখে কিছু জ্ঞাপন করা। সাধারণ ভাবে প্রতিবেদন বলতে আমরা খবরের কাগজের আর্টিকেল বুঝি, কিন্তু খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদন ছাড়াও আর‌ও নানা ধরনের প্রতিবেদন হতে পারে। যেমন: গবেষণা-প্রতিবেদন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়ভিত্তিক প্রতিবেদন, তদন্ত-প্রতিবেদন প্রভৃতি। তবে পরীক্ষার্থীদের কাছে সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের গুরুত্ব বেশি।


সংবাদপত্রের প্রতিবেদন মূলত দুই ধরনের হয়। 

১: সংবাদ-প্রতিবেদন

২: সম্পাদকীয় প্রতিবেদন

প্রতিবেদন রচনার উদ্দেশ্য

প্রতিবেদন একটি উদ্দেশ্যমূলক রচনা। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য বিভিন্ন হয়। সংবাদ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য সংবাদ পরিবেশন করা, সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য সংবাদ বিশ্লেষণের মাধ্যমে জনমত গঠন করা। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বাইরে আরও যে সব প্রতিবেদন আছে, তাদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্ট রয়েছে। যেমন: গবেষণা প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হল গবেষণার বিবরণ ও ফলাফল জ্ঞাপন করা, তদন্ত প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হল তদন্তের ফলাফল কর্তৃপক্ষকে জানানো। 

সংবাদ প্রতিবেদন রচনার নিয়ম

সংবাদ-প্রতিবেদন বলতে বোঝায় যে সব প্রতিবেদন আমরা খবরের কাগজে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় পাই, সেই খবরগুলি। বাংলা খবরের কাগজের মধ্যে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনগুলিকে আদর্শ সংবাদ-প্রতিবেদন বলা যায়। আনন্দবাজার পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলির গঠন খুঁটিয়ে পড়লেই প্রতিবেদনের গঠন বুঝতে পারা যাবে। সংবাদ-প্রতিবেদন রচনার জন্য কয়েকটি নিয়ম মেনে চলতে হয়। তবে মনে রাখতে হবে, এই নিয়মগুলি কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নয়। প্রতিবেদন একটি মৌলিক সৃষ্টি। এখানে নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করার সুযোগ রয়েছে। আমি এখানে এমন কয়েকটি নিয়মের কথা বলবো, যেগুলি অনুসরণ করলে সহজেই একটি ভালো প্রতিবেদন গড়ে তোলা যাবে।


নামকরণ বা হেডলাইন

প্রতিবেদনে অবশ্য‌ই একটি নামকরণ করতে হয়। নামকরণটি আকর্ষণীয় হ‌ওয়া উচিত। কারণ নামকরণটি আকর্ষণীয় হলেই পাঠক প্রতিবেদন পুরোটা পড়তে আগ্রহ বোধ করবেন। নামকরণে পূর্ণ বাক্য ব্যবহার না করলেও চলে। তবে নামকরণের মধ্যে বিষয়ের যোগটি যেন সরাসরি বোঝা যায়। কয়েকটি আদর্শ নামকরণ এইরকম হতে পারে: "শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে স্কুলেই বন্যাত্রাণ-শিবির", "দুঃস্থ মহিলাদের সহায়তায় এগিয়ে এল ক্লাব", "বনভোজন থেকে ফেরার পথে বাস-দুর্ঘটনা: আহত পাঁচ"। নামকরণের শেষে পূর্ণচ্ছেদ দেওয়া চলবে না, কিন্তু প্রয়োজনে প্রশ্ন চিহ্ন বা বিস্ময়চিহ্ন দেওয়া চলবে। নামকরণের মাঝে কমা চিহ্ন দরকার পড়লে দিতে হবে। 


প্রতিবেদক-পরিচিতি, স্থান ও কাল

সংবাদ-প্রতিবেদনের প্রথমেই প্রতিবেদকের পরিচয়, তারিখ ও প্রতিবেদন রচনার স্থান  লিখতে হয়‌। এই অংশগুলি কমা চিহ্ন দ্বারা পৃথক করতে হবে‌। যেমন: "নিজস্ব সংবাদদাতা, ২রা অক্টোবর, ২০২০, বাঁকুড়া:" পুরো পরিচিতির শেষে একটি কোলন চিহ্ন(:) দিতে হবে। 'নিজস্ব সংবাদদাতা'-র বদলে নিজের নাম লেখা যাবে। কিন্তু যে সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিজের নাম প্রকাশ করা চলে না, সে সব পরীক্ষায় প্রতিবেদন লিখতে হলে নিজের নাম দেওয়া চলবে না। মাধ্যমিক পরীক্ষায় নিজের নাম দেওয়াই ভালো।

সূচনা

প্রতিবেদনের সূচনা খুব‌ই সংক্ষিপ্ত হবে। মোদ্দা কথা হল বেশি গৌরচন্দ্রিকা করা চলবে না। সূচনার প্রথম দুটি বাক্যের মধ্যেই বিষয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে দেওয়া ভালো এবং সূচনার দৈর্ঘ্য ওই দুই একটি বাক্যেই সীমাবদ্ধ হবে। বড়সড় ভূমিকা লেখা চলবে না এবং সূচনা অংশটি আলাদা অনুচ্ছেদ হবে না, মূল প্রতিবেদনের সাথেই লিখতে হবে। মনে রাখতে হবে সংবাদ-প্রতিবেদন কোনো প্রবন্ধ নয়।


মূল প্রতিবেদন

সংবাদ প্রতিবেদনের সূচনার ছোট্ট অংশটি লেখা হয়ে গেলে মূল ঘটনার বিবরণ দিতে হবে সহজ সরল ও সর্বজন-বোধ্য ভাষায়। সংবাদ প্রতিবেদনে ভাষার মারপ্যাঁচ কাম্য নয়, কারণ এই ধরনের প্রতিবেদন লেখা হয় খবরের কাগজের সাধারণ পাঠকদের জন্য; সেই পাঠকরা সবাই উচ্চশিক্ষিত হবেন, এমন কোনো কথা নেই। ঘটনার বিবরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলি লিখতে হবে তা হল: 

• ঘটনার কার্য-কারণ

অর্থাৎ একটি ঘটনা কেন ঘটল। ঘটনার কারণ জানা থাকলে তা সরাসরি লিখতে হবে। ঘটনার পিছনে একাধিক সম্ভাব্য কারণ থাকলে প্রতিটি কারণের উল্লেখ করতে হবে। 

• ঘটনার ফলাফল

ঘটনার ফল ভালো বা মন্দ, দুইই হতে পারে। দুই প্রকার ফল‌ই বিস্তারিত জানাতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য কিছু তথ্য দিতে হবে। তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের সামঞ্জস্য থাকা খুবই জরুরি। 

• ঘটনা সম্পর্কে স্থানীয় মানুষের মতামত

প্রতিবেদনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য স্থানীয় মানুষ অথবা প্রত্যক্ষদর্শীর মন্তব্য কোটেশনে দিতে হয়। এক্ষেত্রে বক্তার নাম প্রকাশ করা যেতে পারে, তবে বিতর্কিত ইস্যু হলে বা বক্তার নাম প্রকাশ করা নিরাপদ না হলে 'নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী/ব্যবসায়ী/প্রত্যক্ষদর্শী/শিক্ষক/ছাত্র' ইত্যাদি দিয়ে কাজ চালাতে হবে।

• কর্তাব্যক্তির বক্তব্য

স্থানীয় মানুষের বক্তব্যের পর ঘটনার সঙ্গে জড়িত কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে কমপক্ষে একজনের বক্তব্য দেওয়া জরুরি। ঘটনা অনুসারে কর্তাব্যক্তি হতে পারেন পঞ্চায়েত প্রধান, পুলিশের ভারপ্রাপ্ত অফিসার(O.C.), পুলিশ সুপার, বিধায়ক, মন্ত্রী,  জেলাশাসক, মহকুমাশাসক, জেলা বনাধ্যক্ষ, হাসপাতাল সুপার, জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক, প্রভৃতি‌।

• প্রতিবেদকের মূল্যায়ন

মূল প্রতিবেদনের শেষ অংশে প্রতিবেদক সংক্ষেপে নিজের মূল্যায়ন যোগ করতে পারেন, কিন্তু এই মূল্যায়ন বিস্তারিত হবে না। প্রতিবেদকের মতামত পাঠকের উপর চাপিয়ে না দিয়ে পাঠককে নিজস্ব মতামত গড়ে তুলতে সাহায্য করাই হবে এই মূল্যায়নের উদ্দেশ্য।



সম্পাদকীয় প্রতিবেদন রচনার নিয়ম

সম্পাদকীয় প্রতিবেদন বলতে বোঝায়, সাময়িক কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে বিখ্যাত খবরের কাগজের সম্পাদক মহাশয় যে প্রতিবেদন রচনা করেন।

সম্পাদকীয় প্রতিবেদন রচনার নিয়ম সাধারণ সংবাদ-প্রতিবেদন রচনার থেকে অনেকটাই আলাদা। আনন্দবাজার পত্রিকার ৪এর পাতায় বামদিকে একটি বা দুটি সম্পাদকীয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় প্রতিবেদন সাধু ভাষায় লেখা হয়। আমাদের চলিত ভাষায় লিখতে হবে। কিন্তু আনন্দবাজারের এই প্রতিবেদনগুলি পড়লে এ সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন কখন‌ও ঘটনার বিবরণ দেয় না। এই প্রতিবেদনের কাজ হলো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সংক্ষেপে অথচ যুক্তিপূর্ণ ভাবে ব্যাখ্যা করা। 


তথ্য ও যুক্তি

এখানে তথ্যের ব্যবহার কম হবে, যুক্তির ব্যবহার হবে বেশি। প্রয়োজনে তথ্য ব্যবহার করা যাবে, কিন্তু সেই তথ্য যেন যুক্তিকেই দৃঢ়তা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।


বর্ণনা নয়, বিশ্লেষণ

বর্ণনা নয়, বিশ্লেষণ‌ই সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মূল কথা। প্রয়োজনে ঘটনাসূত্র উল্লেখ করা যাবে, ঘটনার বিবরণ দেওয়া চলবে না।


গঠন

সম্পাদকীয় প্রতিবেদনেও হেডলাইন দিতে হবে। কিন্তু এখানে শুধুমাত্র তারিখ উল্লেখ করলেই হবে, শুরুতে স্থান বা প্রতিবেদকের পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই। নিচে 'সম্পাদকের স্বাক্ষর' কথাটি লিখে দিলেই হবে। নিজের স্বাক্ষর করার দরকার নেই।


বিষয় ও ভাষা

কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, অনেকদিন ধরে ঘটে চলা পরিস্থিতি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নিয়েই সম্পাদকীয় প্রতিবেদন লেখা হয়। ছোটোখাটো ঘটনা নিয়ে সম্পাদকীয় প্রতিবেদন লেখা হয় না। তাই সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের ভাষা জলের মতো সহজ হ‌ওয়ার দরকার নেই। ভাষায় যুক্তির বিন্যাসকে সফল করার জন্য অনেক সময় জটিল বাক্যবিন্যাসের প্রয়োজন হতে পারে।


মতামত

সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে সম্পাদক মহাশয় একটি মতামতকে প্রাধান্য দেবেন। ঘটনার পরিপূর্ণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হ‌ওয়ার প্রচেষ্টা দেখা যাবে। বিশ্লেষণ নিরপেক্ষ হবে, কিন্তু শেষ সিদ্ধান্তটি মাঝামাঝি হবে না। সম্পাদক স্পষ্ট একটি মত প্রকাশ করবেন।


প্রতিবেদনের নমুনা: সংবাদ-প্রতিবেদন

         তীব্র যানজট, মাটি হল কেনাকাটার খুশি

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঁকুড়া, ২ অক্টোবর, ২০২০: পুজোর মরশুম, হাসিমুখে কেনাকাটা, ভিড়ে থিকথিক বাজার, আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যানজট। বাঁকুড়া শহরের নূতনচটি থেকে মাচানতলা পর্যন্ত পুরো রাস্তার এটাই বর্তমান ছবি। পুজোর বাজারের অর্ধেক আনন্দ‌ই যেন মাটি হয়ে যাচ্ছে তীব্র যানজটে। একদিকে সংকীর্ণ রাস্তা ও অন্য দিকে জবরদখল হয়ে যাওয়া ফুটপাথের কারণেই পুজোর সিজনে বাঁকুড়া শহরের বাজার এলাকায় পা ফেলার জায়গা মিলছে না, বাজার করে ফিরতেও সময় লেগে যাচ্ছে অনেক বেশি। যানজটে আটকে পড়ার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। সমস্যার সমাধানে জেলা পুলিশ একাধিক উদ্যোগ নিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বিশেষত সন্ধ্যার দিকে প্রায়শ‌ই তীব্র ভিড়ে আটকে পড়তে হচ্ছে যানবাহন থেকে শুরু করে কেনাকাটা করতে বেরোনো মানুষকে। 
        শহরের বাসিন্দাদের বক্তব্য অনুযায়ী যানজট নিয়ন্ত্রণে এই ব্যর্থতা শুধুমাত্র পুলিশের নয়, শহরের পৌর প্রশাসনেরও। দীর্ঘ দিন ধরে শহরের মানুষ বাজার এলাকাটির ফুটপাথ সংস্কার করার দাবি জানিয়ে আসছেন। যদিও ফুটপাথ সংস্কার করলেই সমস্যার কতটা সমাধান হবে তা বলা যায় না। ফুটপাথ সংস্কার করার পাশাপাশি পুজোর মরশুমে ভিড় নিয়ন্ত্রণেও জোর দিতে হবে। বিশেষত বাজার এলাকায় চারচাকা ও তিনচাকা যানবাহন নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে হবে। এ বিষয়ে বাঁকুড়া জেলা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত ট্রাফিক অফিসার শান্তনু মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আগামী কাল থেকেই বাজার এলাকায় যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশের তরফে নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। বাজার এলাকায় চারচাকা গাড়ির প্রবেশ ইতিমধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আগামী কাল থেকে তিন চাকা গাড়িও ঢুকতে দেওয়া হবে না। এছাড়া নিকটবর্তী স্কুলের মাঠে অস্থায়ী ভিত্তিতে মোটরবাইক পার্কিং-এর‌ও ব্যবস্থা করা হবে। 

উপরের প্রতিবেদনটি একটি সংক্ষিপ্ত ও নমুনা প্রতিবেদন। প্রকৃত প্রতিবেদন আকারে এর চেয়ে বড়ো ও বিস্তারিত হতে পারে। পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত ও তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবলম্বনে প্রতিবেদন রচনার নমুনা যোগ করবো।


আর‌ও পড়ুন 

মন্তব্যসমূহ

আর‌ও পড়ে দেখুন

তির্যক বিভক্তি কাকে বলে

লোকনিরুক্তি কাকে বলে

মিল যুক্ত শব্দ | মিল করে শব্দ লেখ

অপিনিহিতি কাকে বলে

ধ্বনি ও বর্ণের মধ্যে পার্থক্য

অভিশ্রুতি কাকে বলে?

নিরপেক্ষ কর্তা কাকে বলে

বিভাজ্য ধ্বনি কাকে বলে | অবিভাজ্য ধ্বনি কাকে বলে