বিশেষ্য পদ | বিশেষ্য পদের বিস্তারিত আলোচনা | বিশেষ্য পদ কাকে বলে
বিশেষ্য কথার আক্ষরিক অর্থ, সংজ্ঞা ও ধারণা
আজকের আলোচনায় আমরা বিশেষ্য পদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। 'বিশেষ্য' কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল, 'যাকে বিশেষ করা যায় বা পৃথক করা যায়'। দোষ গুণ ইত্যাদির দ্বারা আলাদা করা যায় বলেই বিশেষ্য নামকরণটি করা হয়েছে। বাস্তব জগতে এবং আমাদের ধারণায় যা কিছুর কোনো অস্তিত্ব আছে, তারই একটি নাম আছে। এই সমস্ত নামগুলি বিশেষ্যের অন্তর্ভুক্ত।
[এখানে বলে রাখা ভালো, বস্তু বা পদার্থের বা ধারণার নামটিই বিশেষ্য। যার নাম, সেটি বিশেষ্য নয়। অর্থাৎ, 'জল' একটি বিশেষ্য: এর অর্থ-- জ্+অ+ল্+অ-- এই ধ্বনিসমষ্টিটি বিশেষ্য; যে তরল পদার্থ আমাদের তৃষ্ণা দূর করে সেই পদার্থটি বিশেষ্য নয়।]
বিশেষ্য পদ কাকে বলে
যে পদের দ্বারা কোনো বস্তু, প্রাণী, শ্রেণি, সমষ্টি, ভাব, কাজ ইত্যাদির নাম বোঝানো হয় তাকে বিশেষ্য বলে।
এক কথায় বলা যায়: যে পদের দ্বারা যে কোনো কিছুর নাম বোঝায়, তাকে বিশেষ্য পদ বলে।
উদাহরণ: রাম(ব্যক্তি), মাটি(বস্তু), কলকাতা(স্থান), ডাক্তার(শ্রেণি), লজ্জা(ভাব), খাওয়া(কাজ) ইত্যাদি।
[** কোনো পদের উদাহরণ বাক্য ছাড়া দেওয়া উচিত নয়। কারণ বাক্যে প্রয়োগের উপর পদের পরিচয় নির্ভর করে। কিন্তু আমরা উদাহরণ দেওয়ার সুবিধার্থে একক শব্দকেই পদ হিসেবে অনেক স্থলে দেখাবো। এক্ষেত্রে শব্দগুলির বহুপ্রচলিত অর্থটি ধর্তব্য।]
বিশেষ্যের শ্রেণিবিভাগ:
আমাকে YouTube-এ সাবস্ক্রাইব করার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
১: সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য:
যে বিশেষ্যের দ্বারা একটি মাত্র সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি, বস্তু, স্থান ইত্যাদির নাম বোঝানো হয়, তাকে সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য বলে।
যেমন: 'সঞ্জয়' বললে একটিমাত্র মানুষের কথা বলা হয়। হতে পারে, পৃথিবীতে অসংখ্য সঞ্জয় নামের ব্যক্তি আছে। কিন্তু যখন কোনো বক্তা 'সঞ্জয়' নামে কাউকে উল্লেখ করে, তখন বক্তা একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকেই বোঝাতে চায় এবং শ্রোতাও তা-ই বোঝে। সুতরাং, ব্যক্তিনাম মাত্রই সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য। এ ছাড়া, স্থান নাম, যেমন: বাঁকুড়া, ভারত, বাংলাদেশ; নদীর নাম--গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র; নির্দিষ্ট বস্তুর নাম--কোহিনূর, গ্রামের নাম, রাস্তার নাম, পর্বতের নাম, গ্রহের নাম, মাসের নাম, বারের নাম, বইয়ের নাম, ইত্যাদি সবই সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য। ইংরাজিতে একে Proper noun বলে।
২: শ্রেণিবাচক বিশেষ্য:
যে বিশেষ্য দ্বারা একই ধরণের বা একই গোত্রের সকল ব্যক্তি, স্থান, প্রাণী ইত্যাদির নাম বোঝানো হয়, তখন তাকে শ্রেণিবাচক বিশেষ্য বলে।
যেমন: 'গোরু' বললে কোনো নির্দিষ্ট গোরু না বুঝিয়ে পৃথিবীর সকল গোরুকেই বোঝানো হয়। 'শহর' বললে কোনো একটি শহর বোঝায় না। 'শিক্ষক' বললে সকল শিক্ষক বোঝায়। তাই এই বিশেষ্যগুলি শ্রেণিবাচক বিশেষ্য।
আরও উদাহরণ: গাছ, আমগাছ, ছাত্র, উকিল, মানুষ, ব্রাহ্মণ, শিশু, পশু, হরিণ(হরিণ একটি নির্দিষ্ট পশু কিন্তু হরিণ তো একটি নয়, 'হরিণ' বললে পৃথিবীর সব হরিণকে বোঝায়), টিয়া, গাঁদা, দেশ, জেলা, নদী, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি। ইংরাজিতে শ্রেণিবাচক বিশেষ্যকে Common noun বলে।
৩: সমষ্টিবাচক বিশেষ্য:
যে বিশেষ্যের দ্বারা কোনো সমষ্টি বা যূথের নাম বোঝায়, তাকে সমষ্টি বাচক বিশেষ্য বলে।
সমষ্টিবাচক বিশেষ্য বুঝতে হলে এর উদাহরণগুলি ভালো করে লক্ষ করতে হবে। একটি সমষ্টিকে যখন কোনো নাম দেওয়া হয়, তখন সেই নামটি সমষ্টিবাচক বিশেষ্য হয়। যেমন একসাথে অনেক গোরু থাকলে গোরুর সেই সমষ্টিকে পাল বলা হয়, একসঙ্গে অনেক মাছ দেখা গেলে সেই সমষ্টিকে আর দল না বলে ঝাঁক বলা হয়। আবার একসাথে অনেক সৈনিক থাকলে সেই সমষ্টিকে বাহিনী বলা হয়, একসঙ্গে অনেক নৌকা দেখলে তাকে বহর বলা হয়। সুতরাং পাল, ঝাঁক, বাহিনী, বহর, এইগুলি সমষ্টি বাচক বিশেষ্যের উদাহরণ।
সমষ্টি বাচক বিশেষ্যের উদাহরণ
যেমন: দল, পাল, গোষ্ঠী, পরিবার, সমাজ, সভা, সমিতি, দল, গণ, জাতি, বৃন্দ, যূথ, ঝাঁক, গোছা, আঁটি,সারি, পংক্তি, ডজন, জোড়া, বোঝা, সংসদ ইত্যাদি। ইংরাজিতে একে বলে Collective noun.
৪: ভাববাচক বিশেষ্য:
যে বিশেষ্যের দ্বারা কোনো বিমূর্ত ভাবের নাম বোঝানো হয়, তাকে ভাববাচক বিশেষ্য বলে।
ভাব বাচক বিশেষ্য হল ধারণা বা অনুভূতি। মনের ভাব বা বিমূর্ত ধারণাকে ভাব বলে। যেমন শোক একটি অনুভূতি। শোকের উপস্থিতি শুধুমাত্র মানুষের মনের ভিতর। এটি মানসিক ভাব। এছাড়া বাহ্যিক ভাবও আছে, কিন্তু সেগুলিও মনের মধ্যেই অনুভব করতে হয়। কোনো কোনো ভাবকে আমরা পরিমাপ করার ব্যবস্থাও আবিষ্কার করেছি। যেমন: দাম বা মূল্য। দাম আসলে কোথাও নেই, কিন্তু ব্যবসার স্বার্থে আমরা দামের পরিমাপ স্থির করি টাকার অঙ্কে। একটি জিনিসের 'দাম' একশো টাকা বললে বস্তুটির কোনো সহজাত ধর্ম বোঝানো হয় না। দাম আসলে একটি ধারণা বা বোধ, এই ধারণাটি আমরা বস্তুর উপর চাপিয়ে দিই।
ভাব বাচক বিশেষ্যের উদাহরণ
ভাববাচক বিশেষ্যের উদাহরণ হল: ভয়, লজ্জা, ঘৃণা, অস্বস্তি, ক্রোধ, প্রেম, সুখ, আনন্দ, দুঃখ, শোক, শান্তি, আদর্শ, নীতি ইত্যাদি। ইংরাজিতে এটি Abstract noun এর মধ্যে পড়ে।
৫: গুণবাচক বিশেষ্য:
যে বিশেষ্যের দ্বারা কোনো গুণ, ধর্ম, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদির নাম বোঝানো হয়, তাকে গুণবাচক বিশেষ্য বলে।
যেমন: সততা, সৌন্দর্য, ভদ্রতা, সরলতা, বড়ত্ব, হীনতা, উচ্চতা ইত্যাদি। গুণবাচক বিশেষ্যও ইংরাজিতে Abstract noun-এর মধ্যে পড়ে।
[** এখানে মনে রাখা দরকার: গুণবাচক বিশেষ্য অন্য কোনো পদের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হয় না। গুণ বা বৈশিষ্ট্যের নামটি প্রকাশ করে। যেমন আমরা বলতে পারি , "সৎ মানুষ" কিন্তু "সততা মানুষ" বলা যায় না। অর্থাৎ 'সৎ' পদটি অন্য পদের গুণ প্রকাশ করলেও 'সততা' পদটি তা করছে না। তাই 'সৎ' ও 'সততা' একই পদ নয়।
তা ও ত্ব প্রত্যয় যোগে গঠিত অধিকাংশ শব্দ গুণবাচক বিশেষ্য হয়। কিছু ক্ষেত্রে ভাববাচক বিশেষ্যও হয়।
৬: অবস্থাবাচক বিশেষ্য:
যে বিশেষ্যের দ্বারা কোনো অবস্থা বা পরিস্থিতির নাম বোঝানো হয়, তাকে অবস্থা-বাচক বিশেষ্য বলে।
যেমন: বার্ধক্য, দারিদ্র্য, শৈশব, রাত্রি, সকাল, বিপদ, সংকট, সুপ্তি, শান্তি, নৈরাজ্য, গোলমাল, হট্টগোল ইত্যাদি। ইংরাজিতে অবস্থাবাচক বিশেষ্যও Abstract noun-এর মধ্যে পড়ে।
[ভাববাচক, গুণবাচক ও অবস্থাবাচক, এই তিন প্রকার বিশেষ্যকে অনেকেই একটি শ্রেণিতে ফেলতে চান(ভাববাচক), কারণ এই তিনটিই বিমূর্ত কল্পনা। ইংরাজিতেও তিনটিকেই Abstract noun-এর মধ্যে ধরা হয়। আমরাও এই তিনটিকে একটি শ্রেণিতে ফেলার পক্ষপাতী। কিন্তু এই তিনটিকে একই শ্রেণিতে ফেলতে হলে 'ভাববাচক' নামটি বিভ্রান্তিকর। ইংরাজি নামটির বাংলা অনুবাদ করে 'বিমূর্ত বিশেষ্য' নামকরণ করে দিলে ঝামেলা চুকে যায়।]
ভাববাচক, গুণবাচক ও অবস্থাবাচক বিশেষ্য সম্পর্কে আরও জানতে নিচের ভিডিওটি দেখুন।
৭: বস্তুবাচক বিশেষ্য:
যে বিশেষ্যের দ্বারা কোনো জড় বস্তুর নাম বোঝানো হয়, তাকে বস্তুবাচক বিশেষ্য বলে।
যেমন: জল, মাটি, চিনি, চাল, পাথর, কাঠ, মাংস, গ্যাস, ধুলো, কাদা, সোনা, তামা ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে: প্রাণহীন হলেই তাকে বস্তুবাচক বিশেষ্য বলা যাবে না।
৮: ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য:
যে বিশেষ্যের দ্বারা কোনো কাজের নাম বোঝানো হয়, তাকে ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য বলে।
যেমন: খাওয়া, যাওয়া, দেখা, বলা, পড়া, শোনা, হাঁটা, পড়ানো, দেখানো, শোনানো, গ্রহণ, বর্জন, দর্শন, পঠন-পাঠন, ভোজন ইত্যাদি।
ধাতুর সাথে 'আ' 'আনো' 'অন' প্রত্যয় যোগে ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য তৈরি হয়। (উদাহরণ: দেখ্+আ=দেখা; দেখ্+আনো=দেখানো; দৃশ্+অন=দর্শন)
বাক্যে প্রয়োগের উদাহরণ: "আমরা খেলা দেখতে যাবো।"-- এই বাক্যে 'খেলা' বিশেষ্য।
[**ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদের মধ্যে বিস্তর ফারাক। ক্রিয়াপদের দ্বারা 'কাজ করা' বোঝানো হয়, ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য দ্বারা শুধুমাত্র কাজের নাম বোঝানো হয়। ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য ও সমষ্টিবাচক বিশেষ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে নিচের ভিডিওটি দেখুন।]
৯: সংখ্যাবাচক বিশেষ্য:
যে বিশেষ্যের দ্বারা সংখ্যার নাম বোঝানো হয়, তাকে সংখ্যাবাচক বিশেষ্য বলে।
উদাহরণ দেওয়ার আগেই একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে দিই-- সংখ্যাবাচক বিশেষ্য অন্য পদের সংখ্যা প্রকাশ করবে না। শুধু একটি সংখ্যাকে বোঝাবে। বাক্যে উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে:
"আমি সাত-পাঁচ বুঝি না।" "তিন আর চারে সাত হয়।"-- এই দুটি বাক্যের 'সাত-পাঁচ', 'তিন', 'চারে', 'সাত' পদগুলি সংখ্যাবাচক বিশেষ্য।
১০: ধ্বন্যাত্মক বিশেষ্য:
যে বিশেষ্য কোনো ধ্বন্যাত্মক শব্দ থেকে তৈরি হয়, তাকে ধ্বন্যাত্মক বিশেষ্য বলে।
যেমন: মেঘের কড়কড় শোনা গেল।(কড়কড়)
বুকের ধুকপুকুনিটুকু টিকে আছে।(ধুকপুকুনিটুকু)
বৃষ্টির ঝমঝমানি কমছে না।(ঝমঝমানি)।
বিশেষ্য পদ চেনার উপায়
বিশেষ্য পদকে সহজে চেনার কয়েকটি উপায় আছে। আলোচনা পড়ার আগে নিচের ভিডিওটি দেখে সহজেই বিশেষ্য পদ চেনার কৌশল জানুন।১: যার অস্তিত্ব আছে তাই বিশেষ্য হবে। কারণ অস্তিত্ব থাকলেই তার একটি নাম থাকবে।
২: র, এর, কে, এ, তে প্রভৃতি বিভক্তি যোগ করা গেলে সেই পদটি হয় বিশেষ্য হবে নতুবা সর্বনাম হবে। সর্বনাম না হলে অবশ্যই বিশেষ্য হবে।
৩: বাস্তবে অস্তিত্ব নেই কিন্তু কল্পনায় অস্তিত্ব আছে, এমন পদও বিশেষ্য হবে। যেমন: আদর্শ, শান্তি, সুখ, স্নেহ ইত্যাদি।
৪: কর্তৃ, কর্ম, করণ, নিমিত্ত অপাদান ইত্যাদি কারক যাদের হয় তারা হয় সর্বনাম, নয় বিশেষ্য। সর্বনাম না হলে অবশ্যই কারকপদমাত্রই বিশেষ্য হবে। কোনো পদকে কারকে প্রয়োগ করা যাচ্ছে কিনা তা দেখে নিলেই বোঝা যাবে পদটি বিশেষ্য কিনা।
৫: খাওয়া, যাওয়া, আসা, দেখা, বলা, খেলা, জানা, নেওয়া, দেখানো, শোনানো, গ্রহণ, বর্জন, শোষণ, শ্রবণ প্রভৃতি আ, আনো এবং অনট্ প্রত্যয়যোগে গঠিত শব্দ বিশেষ্য হয়। মনে রাখতে হবে, এগুলি ক্রিয়া নয়। এগুলি কাজের নাম বোঝায়। তবে বাংলা ধাতুর সাথে আ/আনো প্রত্যয় যোগে গঠিত শব্দ বিশেষ্য ও বিশেষণ দুইই হতে পারে। বাক্যে প্রয়োগ অনুসারে সেটি বুঝে নিতে হবে।
আরও পড়ুন
বিশেষ্য পদ চিহ্নিত করে তাদের শ্রেণি লেখ।
১: তোমাকে আজকাল আমার বাড়ির আনাচে কানাচে দেখতে পাই কেন?
২: সকাল হলে পাখিদের ডাক শোনা যাবে।
৩: রুদ্রদেবের কৃপা তোমার জীবনকে সুখ ও শান্তিতে ভরিয়ে তুলুক।
৪: জন্ম ও মৃত্যু বিধাতার হাতে।
৫: মানুষ নিজের ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন দিলে তার আর সম্মান থাকে না।
৬: রুগীর দেহে হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনিটুকু এখনো আছে।
৭: আমি প্রশ্ন লিখে দেবো, তুমি উত্তর লিখবে।
৮: বিধবা মোকদ্দমাটি হাইকোর্টে হারিল।
৯: আমাদের ভুলো অত্যন্ত প্রভুভক্ত।
১০: আকাশে যত তারা আছে তার সংখ্যা মানুষের কল্পনাতেও ধরবে না।
১১: আমি বাজার থেকে এক কেজি ল্যাংড়া এনেছি।
১২: মানুষের সাতে পাঁচে মাথা গলিও না।
মন্তব্যসমূহ
Gh er rotna ekta.
Gh er rotna ekta.