সর্বনাম পদ : বিস্তারিত আলোচনা | সর্বনাম কাকে বলে

সর্বনাম কাকে বলে ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা

সর্বনাম পদ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়ার জন্য নিচের এই পাঁচ মিনিটের ভিডিওটি দেখে তার পর নিচে বিস্তারিত আলোচনা পড়তে পারেন। ভিডিওটি দেখে ভালো লাগলে আমাকে ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করতে এখানে ক্লিক করুন।




সর্বনাম কথার অর্থ 'সকল নাম' বা 'সব নাম'। কথা বলার সময় একটি নামকে বার বার ব্যবহার করা একদিকে যেমন বিরক্তিকর, অন‍্যদিকে তেমনি তাতে ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট হয়। এই সমস‍্যা দূর করার জন‍্য বিশেষ‍্য পদের পরিবর্তে সর্বনাম পদ ব‍্যবহার করা হয়।



সর্বনাম পদ কাকে বলে 

বিশেষ‍্য পদের পরিবর্তে যে পদ ব‍্যবহার করা হয়, তাকে সর্বনাম পদ বলে।

সর্বনাম পদের এই সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞাটিই নির্ভুল সংজ্ঞা। বড় থেকে ছোটো, সবার‌ই এই সংজ্ঞা লেখা উচিত। একে অকারণে জটিল করে তোলার কোনো দরকার নেই।

সর্বনাম পদের উদাহরণ

আমি, আমরা, তুমি, আপনি, তুই , তোমরা, সে, তিনি, যে, কে, কী, কারা, যে, যিনি, কেউ, সবাই, ও, এ, এটা, ওটা, ইত্যাদি। সর্বনাম পদে বিভক্তি ও নির্দেশক যুক্ত হলেও সেটি সর্বনাম পদ‌ই থাকে। তাই আমার, আমাকে, তোমার, তার, তাদের, তোমাদেরকে, সেগুলিকে, ওইটি, ওদের, কাকে, কার, এইসব পদগুলিও সর্বনাম পদের‌ই উদাহরণ।

সর্বনাম পদের উদাহরণ দেওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হয়। খেয়াল রাখতে হবে সর্বনাম পদ থেকে কিছু বিশেষণ পদের জন্ম হয়, সেগুলিকে সর্বনামীয় বিশেষণ বলে। যেমন: যত, তত, যেভাবে, কত, এত, কীভাবে, ইত্যাদি পদ দেখতে সর্বনামের মতো হলেও এরা আসলে সব বিশেষণ পদ।


সর্বনামের প্রকারভেদ :


১: ব‍্যক্তিবাচক সর্বনাম বা পুরুষবাচক সর্বনাম

ব‍্যক্তিনামের পরিবর্তে যে সর্বনাম ব‍্যবহৃত হয়, তাকে ব‍্যক্তিবাচক সর্বনাম বলে। 
একে পুরুষবাচক সর্বনাম‌ও বলে । তার কারণ এই সর্বনামগুলিতে উত্তম, মধ্যম ও প্রথম, তিনটি পুরুষকেই পাওয়া যায়। এর বাইরে অন্য সর্বনামগুলি সব‌ই প্রথম পুরুষ হয়।

উদাহরণ : আমি, তুমি, আমরা, তোমরা, সে , তারা ইত্যাদি। এখানে দেখা যাচ্ছে, এই প্রতিটি সর্বনাম‌ই কোনো না কোনো ব‍্যক্তি‌কে বা ব‍্যক্তি-সমূহকে বোঝাচ্ছে। এই সব ব‍্যক্তির‌ই নিজের নিজের নাম আছে। অনেক সময় ঐ নামগুলি ব‍্যবহার না করে এই সর্বনাম‌গুলি আমরা ব‍্যবহার করে থাকি।



২: নির্দেশক সর্বনাম :

যে সর্বনামগুলি নিকটবর্তী বা দূরবর্তী কোনো ব্যক্তি, বস্তু ইত‍্যাদিকে নির্দেশ (indicate) করার জন‍্য ব‍্যবহার করা হয়, তাদের নির্দেশক সর্বনাম বলে।

উদাহরণ : এ, ও , ইহা , উহা , এই , ওই  ইত্যাদি।

নির্দেশক সর্বনাম দুই প্রকার : নিকট নির্দেশক ও দূর নির্দেশক। 

নিকট নির্দেশক সর্বনামগুলি কাছের জিনিসকে নির্দেশ করে। যেমন: এই, এ।

দূর নির্দেশক সর্বনামগুলি দূরের জিনিসকে নির্দেশ করে। যেমন : ওই, ও।
সতর্কতা: নির্দেশক সর্বনামগুলি বিশেষ্য পদের পূর্বে অবস্থিত হলে বিশেষণ পদে পরিণত হয়। যেমন: এই ছেলেকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না।

৩: অনির্দেশক সর্বনাম :

যে সর্বনামগুলি কোনো অনির্দিষ্ট বিশেষ‍্যের পরিবর্তে ব‍্যবহৃত হয়, তাদের অনির্দেশক সর্বনাম বলে।

উদাহরণ : কেউ , কোনো, যে-কেউ , যা-কিছু , কেউ-কেউ ইত‍্যাদি। লক্ষণীয় বিষয় হলো: এই সর্বনামগুলি অনির্দিষ্ট ব্যক্তি, বস্তু ইত্যাদিকে বোঝাচ্ছে।


৪: প্রশ্নবাচক সর্বনাম : 

যে সর্বনামের দ্বারা প্রশ্নের মাধ‍্যমে তার পশ্চাতের বিশেষ‍্যটি জানতে চাওয়া হয়, তাকে প্রশ্নবাচক সর্বনাম বলে। 

উদাহরণ : কে , কোন(কোনো/কোন‌ও নয়), কী** ইত‍্যাদি
সতর্কতা: কী খাবার, কোন ব‌ই, এইভাবে বিশেষ্য পদের পূর্বে অবস্থিত হলে এই সর্বনামগুলি বিশেষণ পদে পরিণত হয়। তখন এদের সর্বনামীয় বিশেষণ বলা হবে।
[** বাংলায় 'কী' এবং 'কি'-এর মধ‍্যে অনেকের মনে বিভ্রান্তি আছে। 'কী' এবং 'কি' সম্পূর্ণ আলাদা পদ। 'কী' একটি সর্বনাম এবং 'কি' একটি অব‍্যয়। 'কি' প্রশ্নের উত্তরে 'হ‍্যাঁ'/ 'না' উত্তর আসবে। অন‍্যদিকে 'কী' প্রশ্নের উত্তরে আসবে সর্বনামের পশ্চাৎ-বর্তী বিশেষ‍্য‌টি। সোজা কথায়, 'কী' একটি Wh-question এবং 'কি' একটি Yes/No question.]
বিষয়টি বিস্তারিত জানতে এই আলোচনাটি পড়ুন



৫: সাপেক্ষ সর্বনাম বা নিত‍্যসম্বন্ধী সর্বনাম :

সর্বনামের যে জোড়াগুলির একটি ব‍্যবহৃত হলে অপরটিও ব‍্যবহৃত হয় অর্থাৎ, একটির সাপেক্ষে অপরটি ব‍্যবহৃত হয়, তাদের সাপেক্ষ সর্বনাম বা নিত‍্যসম্বন্ধী সর্বনাম বলে।

উদাহরণ : যা-তা, যে-সে, যিনি-তিনি ইত‍্যাদি।


৬: আত্মবাচক সর্বনাম :

যে সর্বনামগুলি বিশেষ ভাবে কোনো ব‍্যক্তির নিজেকেই বা আত্মভাবকে প্রাধান্য দেওয়ার জন‍্য ব‍্যবহার করা হয়, তাদের আত্মবাচক সর্বনাম বলে।

উদাহরণ : স্বয়ং , নিজে , নিজ , খোদ , নিজে-নিজে , আপনি(কবিতায় 'নিজে' অর্থে ব‍্যবহৃত)। 




৭: অন‍্যাদিবাচক সর্বনাম :

যে সর্বনামের দ্বারা অপর বা বিকল্প কোনো ব‍্যক্তি বা বস্তু বোঝানো হয়, তাকে অন‍্যাদিবাচক সর্বনাম বলে।

যেমন : অন‍্য, অপর, অন‍্যান‍্য ইত্যাদি।

বাক‍্যে প্রয়োগ : অপরে কী বলবে, তা ভেবে কাজ করা যযায় না।
সতর্কতা: অন্য লোক, অপর ব্যক্তি, অন্যান্য বিষয়, এইভাবে বিশেষ্য পদের পূর্বে অবস্থিত হলে অন্যাদিবাচক সর্বনামগুলি বিশেষণ পদে পরিণত হয়। তখন এদের সর্বনামীয় বিশেষণ বলা হয়।


৮: সাকল‍্যবাচক সর্বনাম:

যে সর্বনামের দ্বারা কোনো সমষ্টির সকলকে বোঝানো হয়, তাকে সাকল‍্যবাচক সর্বনাম বলে। 

যেমন: সবাই, উভয়, সকলে ইত‍্যাদি।
সতর্কতা: সব খাবার, সব জিনিস, উভয় পক্ষ, এইভাবে একটি বিশেষ্যের আগে ব্যবহৃত হলে সাকল্যবাচক সর্বনামগুলি বিশেষণ পদে পরিণত হয়। তখন এদের সর্বনামীয় বিশেষণ বলা হয়।



৯: যৌগিক সর্বনাম:

একাধিক সর্বনামের যোগে যে সর্বনাম গঠিত হয় তাকে যৌগিক সর্বনাম বলে। একে সংযোগমূলক সর্বনাম‌ও বলা হয়।

যেমন: যে কেউ, কে একটা, যা কিছু ইত্যাদি।

মনে রাখতে হবে, সর্বনাম পদের দ্বিত্ব প্রয়োগ ঘটলে তাকে যৌগিক সর্বনাম বলা যাবে না। যেমন: কে কে যাবে? যারা যারা আসতে চায় আসুক।

সর্বনামের বিভক্তিগ্রাহী রূপ :



বেশিরভাগ সর্বনামের সাথে বিভক্তি যোগ করার সময় সর্বনামটির রূপ বদলে যায়। এই পরিবর্তিত রূপকে বলা হয় সর্বনামের বিভক্তিগ্রাহী রূপ। 

উদাহরণ সহযোগে বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। 

যেমন: আমি+কে=আমাকে (আমিকে নয়)।
তুমি+কে=তোমাকে (তুমিকে নয়)।
সে+কে=তাকে (সেকে নয়)।

উপরের উদাহরণগুলিতে আমরা দেখলাম, বিভক্তি যোগ করার সময় 'আমি' হয়ে গেল 'আমা', 'তুমি' হয়ে গেল 'তোমা' এবং 'সে' হয়ে গেল 'তা'। আমা , তোমা , তা , এইগুলিই সর্বনামের বিভক্তিগ্রাহী রূপ। 

**সর্বনামের বিভক্তিগ্রাহী রূপ সম্পর্কে একটি সতর্কতা


আমি ইন্টারনেটে কয়েকটি সাইটে দেখেছি সর্বনামের বিভক্তিগ্রাহী রূপের সংজ্ঞা‌য় বলা আছে : কর্তৃকারক ভিন্ন অন‍্য কারকে সর্বনাম পদে বিভক্তি যোগ করার সময় সর্বনামের রূপ বদলে যায়‌, এই পরিবর্তিত রূপকে সর্বনামের বিভক্তিগ্রাহী রূপ বলে। 

কিন্তু এই সংজ্ঞাটিতে একটি মারাত্মক ত্রুটি আছে। কারক এখানে ধর্তব্য বিষয় নয়। কারক যাই হোক, যে সর্বনামগুলি‌র অবিভক্তিক রূপ ও বিভক্তিগ্রাহী রূপ আলাদা, সেগুলি যে কারকেই বিভক্তি গ্রহণ করুক, সর্বনামের রূপ বদলাবে। 

দুই ধরণের ভাববাচ‍্যের ক্ষেত্রে কর্তৃকারকে বিভক্তি প্রয়োগ করতে হয় এবং সর্বনামের রূপ বদলায়। (এ ছাড়া কর্তৃবাচ্যেও অনেক সময় কর্তায় বিভক্তি যুক্ত হয়।)

উদাহরণ : আমাকে যেতে হবে। ( কর্তৃকারকে 'কে' বিভক্তি)

আমার যাওয়া হবে না। ( কর্তৃকারকে 'র' বিভক্তি)

মন্তব্যসমূহ

ponderous বলেছেন…
তাহারা+কে= তাহাদিগকে
তাহাদের+কে= তাহাদেরকে/তাদিকে/ তাহাদিগকে
কোনটা সটিক বিভক্তিগ্রাহী রূপ?
ponderous বলেছেন…
ponderous= তুলসী সিংহ
Ananya Pathak বলেছেন…
এখানে বিভক্তি গ্রহণের জন‍্য বহুবচন-নির্দেশক 'রা' বদলে 'দিগ' হয়। মূল রূপ তাহাদিগকে। তবে বিকল্পে 'দিগ'-র পরিবর্তে 'দের'(দিগ + এর = দিগের> দের) ব‍্যবহার সাধু বাংলায় চলেছে। মূল সর্বনাম যেহেতু তাহারা, তাই 'এর' বিভক্তিটা এখানে অনর্থক। রা>দিগ করলেই হয়ে যায়, কিন্তু ভাষা জিনিসটাই এমন যে, কোনো বাঁধা নিয়ম কখনো মানে না।
Unknown বলেছেন…
Give examples of sonjog bachok sorbonam
Ananya Pathak বলেছেন…
সংযোগবাচক সর্বনাম তথা যৌগিক সর্বনামের আলোচনা যুক্ত হল।
গৌরব বলেছেন…
যারা যারা যৌগিক সর্বনাম যদি না হয় তাহলে কিছু কিছু এটাও কি যৌগিক সর্বনাম নয়??
এগুলি কি অনির্দেশক সর্বনাম বলব?

আর‌ও পড়ে দেখুন

মিল যুক্ত শব্দ | মিল করে শব্দ লেখ

সূচিপত্র | Bengali Grammar

সাধু ও চলিত ভাষার ৭টি বৈশিষ্ট্য ও রূপান্তর | Sadhu o cholit bhasha

অপিনিহিতি কাকে বলে

দল বিশ্লেষণ, মুক্ত দল ও রুদ্ধ দল | দল কাকে বলে

১০০+ সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ | সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দের তালিকা | Samochcharito Vinnarthok shabdo

পদ পরিবর্তন | ২৫০+ নির্ভুল পদান্তর

তির্যক বিভক্তি কাকে বলে